বিপুল মিয়া,ফুলবাড়ী প্রতিনিধি :
গাভী পালন করে এখন ফুলবাড়ী উপজেলার মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন আম্বিয়া বেগম । গত ৬ বছর ধরে মেধা আর অক্লান্ত পরিশ্রমের সমন্বিত প্রচেষ্টায় দরিদ্রতাকে জয় করেছেন তিনি । আম্বিয়া বেগমের খামারে এখন ৮টি ফ্রিজিয়ান গাভী ও ৩টি বাছুর রয়েছে। দুধ বিক্রির টাকায় দুই ছেলেমেয়েকে পড়াশোনার পাশাপাশি সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন তিনি। জমিজমা করেছেন । মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে এইচএসসি পাস করছে ।প্রতি মাসের লাভের টাকা বিভিন্ন ব্যবসায় খাটাচ্ছেন।দিন দিন বাড়ছে তাঁর গরুর খামার ।
উপজেলা সদর ইউনিয়নের অভ্যন্তরের বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়াড়ার কামালপুর গ্ৰামে । অভাবের সংসারে স্বামী-সন্তান নিয়ে বেশ কষ্টে দিন কাটান আম্বিয়া । স্বামীর সামান্য আয়ে সংসার চলতো না । নুন আনতে পান্তা ফুরায় মত অবস্থা। অভাব ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী । অভাব-অনটনের কারনে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকত। একসময় ভাগ্য অন্বেষণে (ছিটমহল বিনিময়ের আগে) স্বামী সন্তানসহ চলে যান ভারতের উত্তর প্রদেশের ইটভাটায় । সেখানে দীর্ঘ দিন কাজ করেও কোনো সঞ্চয় করতে পারেননি ।কারন দালালেরা তাদের ইট ভাটায় বিক্রি করে কমিশন নিয়ে নেয় । তাঁরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে শুধু খাওয়া পড়ার মজুরি পেতেন । দিনে দিনে ছেলে মেয়েরা বড় হতে থাকে। দুশ্চিন্তা বাডতে থাকে আম্বিয়ার।
২০১৫ সালে দাসিয়ারছড়া ছিটমহল বাংলাদেশের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত হলে আম্বিয়া স্বামী বাজের আলীসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাড়িতে ফেরেন।এসময় তার শুরু হয় এক কঠিন জীবন যুদ্ধ। হাতে ভালো কাজ ছিলনা । কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না । দুজনে কাজ করেও কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না । সংসারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে চোখে ঘুম ছিল না আম্বিয়া বেগমের । পণ করেন যেভাবেই হোক তিনি আয় রোজগারের চেষ্টা করবেন । নিজের সঞ্চয়ের ৪০ হাজার টাকা এবং স্থানীয় বেসরকারি এনজিও আশা থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ৮০হাজার টাকায় বিদেশি জাতের একটি গরুর বাছুর কেনেন । কিন্তু সেই বাছুর লালন-পালন করতে গিয়ে রোগ ব্যাধিসহ নানা সমস্যায় পড়েন । বাধ্য হয়ে অল্প দামে বিক্রি করে দেন । বাছুর বিক্রির টাকা এবং অন্য আর একটি এনজিও ঠেঙ্গামারা সমবায় সমিতি থেকে আরও ৫০ হাজার টাকা নিয়ে একটি ফ্রিজিয়ান গাভী কেনেন। এরপর থেকে আম্বিয়া বেগমের পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ।গাভী পালন করে পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে প্রশিক্ষণ নেন।ফলে গরুর কোন সমস্যা হলে ছুটে যেতে হয়না প্রাণিসম্পদ চিকিৎসকের কাছে। তিনি নিজেই সবকিছু দেখভাল করেন। গরুকে সকাল বিকেল গোসল করানো, দুধ দোয়ানো, খাবার দেওয়া থেকে শুরু করে গরুর যত্ন সবকিছুই নিজেই করেন । একটি গরু থেকে আম্বিয়া বেগমের খামারে এখন ৮টি গরু ও ৩টি বাছুর। নিজের বাড়ির ২০ শতাংশ জমির পাশাপাশি আরও ৩০ শতাংশ জমি কিনেছেন ।যেখানে চাষ করেছেন বিদেশি ঘাস ও শাকসবজি ।ঘাস গরুকে খাওয়ানোর পাশাপাশি বাজারে বিক্রি করছেন । এখন তার খামারে দুজন শ্রমিক কাজ করেন। প্রতিদিন ৫ টি গাভী থেকে দুধ পান ৮০কেজি । ৪০ টাকা দরে স্থানীয় বাজারে বিক্রির পাশাপাশি কয়েকজন চায়ের দোকানদার এবং পাইকারের কাছে বিক্রি করেন । প্রতি মাসে দুধ বিক্রি করে তার আয় হয় এক লাখ ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা । গরুর ওষুধ পত্র,ভূষি, খৈল শ্রমিক ব্যয় সবকিছু খরচ বাদ দিয়ে মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় করেন । প্রতি মাসে টাকা জমিয়ে তিনি জমি কিনেছেন । এছাড়া ধান চালের ব্যবসায়ে দুইলাখ টাকা খাটাচ্ছেন।গাভী পালন করে স্বাবলম্বী হওয়ার মডেল হিসেবে ফুলবাড়ীতে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন আম্বিয়া । দিনবদলের গল্প এখন উপজেলার গণ্ডি পেরিয়ে বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে গেছে ।এখন স্থানীয় গ্ৰামসহ আশপাশের গ্ৰামের অনেকেই গাভী পালনের দিকে ঝুঁকছেন । তাঁরা বিভিন্ন সময়ে তার কাছে পরামর্শ নিতে ।আম্বিয়া বেগম তাদের নানা পরামর্শ ও সাহায্য সহযোগিতা করছেন । কোনো কাজকে অবহেলা আর উপেক্ষা না করে কঠোর পরিশ্রম করলে সফলতা আসবেই ।এমন কথা জানালেন দ্ররিদ্রকে জয় করা আম্বিয়া বেগম।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. কৃষ্ণমোহন হালদার বলেন, আম্বিয়া বেগম একজন সফল খামারী ও উদ্যোক্তা । নারীদের মধ্যে তিনি সবার জন্য উদাহরণ । আমরা আমাদের সাধ্যমতো তাকে পরামর্শ এবং চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছি।
+ There are no comments
Add yours