“ইসলামিক ব্যাংকিং এর নামে শুভংকরের ফাঁকি” : সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া আজহারী

Estimated read time 1 min read
Ad1

সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া আজহারী

ব্যাংকিং ব্যবস্থা হুজুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার জমানাতে ছিল না। এটা একটা সম্পূর্ণ আধুনিক যুগের নতুন কনসেপ্ট।

আসুন জেনে নিই, ব্যাংক আসলে কী?

একদম সংক্ষেপে যদি বলি,
“Bank is an intermediary between depositors and borrowers”।
“ব্যাংক হচ্ছে আমানতকারী ও ঋণগ্রাহকের মধ্যকার মাধ্যম।”

এই সংজ্ঞা সাধারণ ব্যাংকের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য তেমনি ইসলামিক ব্যাংকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
কিভাবে? সেই আলোচনাই আজ করব ইন শা আল্লাহ।

সাধারণ ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রেঃ
অর্থ জমাদানকারীরা ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন বা আমানত রাখেন এবং ব্যাংক তাকে প্রতিজ্ঞা দেয় যে, বছর শেষে আপনি শতকরা এত টাকা হারে সূদ পাবেন। ব্যাংক সেই জমাকৃত টাকা ঋণগ্রহীতাদের কাছে একটা নির্দিষ্ট শতকরা হারে সূদের উপর লোন দেয়। অতঃপর ব্যাংক যদি জমাদানকারীদেরকে শতকরা ৭ টাকা বছর শেষে সূদ দেয় তবে ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে বছর শেষে শতকরা ১০ টাকা নেয়৷ মাঝখানের এই শতকরা ৩ টাকা হচ্ছে ব্যাংকের লাভ। কাজেই একটি লাভজনক ব্যাংক মানে কৈ এর তেলে কৈ ভাজা।

একই কাজ ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে ইসলামিক ব্যাংকগুলোও করছে। কিভাবে?

এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনাতে যাএয়ার আগে, প্রথমেই আমাদেরকে জানতে হবে, ব্যবসা, উদ্যোগ অথবা কেনাবেচা কেন হালাল আর সূদ কেন হারাম?

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা কুরআন মাজিদে বলছেন, وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا ۚ
“আর আল্লাহ পাক ব্যাবসা বা কেনাবেচাকে হালাল করেছেন এবং সূদকে হারাম করেছেন”। (সূরা বাকারাঃ আয়াত নং-২৭৫)

সূদের উপরে টাকা যে ধার দিচ্ছে তার কোন ধরনের কোন রিস্ক নেই এবং সে কোন পরিশ্রমও করছে না। সে শুধু সূদের উপরে টাকা ধার দিয়ে বসে আছে। মানুষ নির্দিষ্ট সময় শেষে সেই সূদী মহাজনকে ঘরে এসে টাকা আদায় করে যাচ্ছে। সূদীরা টাকা ধার দেয়ার সময়েই স্টাম্পে দস্তখত রাখছে, স্বাক্ষী রাখছে, কাজেই আদায়েও কোন রিস্ক নেই। অপরদিকে কেনাবেচা বা ব্যবসা যে করছে, সে রিস্ক নিচ্ছে এবং শ্রম দিচ্ছে। সূদ হারাম হওয়া এবং ব্যবসা হালাল হওয়ার মূল wisdom এখানে লুকিয়ে আছে। ধরুন, ব্যবসায়ী হিসেবে আমাকে একটি পণ্য প্রথমে ক্রয় করতে হয় দূরবর্তী কোন বাজার থেকে। আমি এই পণ্যটির ownership retain করলাম, মানে মালিকানা অধিগ্রহণ করলাম। এই পণ্যটি আমার মালিকানাতে থাকাবস্থায় নষ্ট হয়ে যেতে পারে, ভেংগে যেতে পারে, চুরি হতে পারে। এই রিস্ক আমি নিয়েছি। অতঃপর আমি সেই পণ্যটি বাজারে নিয়ে যাচ্ছি কিংবা আমার দোকানে ওঠাচ্ছি এবং বিক্রি করছি। এই পুরো প্রক্রিয়াটিতে আমি অনেক রিস্ক নিয়েছি, অর্থ বিনিয়োগ করেছি এবং অনেক শ্রম দিয়েছি। কাজেই ১০ টাকা দিয়ে কিনে কোন পণ্য ১২ টাকা দিয়ে বিক্রি করা জায়েজ। বাড়তি ২ টাকা আমার জন্য উল্লেখিত যৌক্তিক কারণে আমার জন্য হালাল। এটা হচ্ছে কেনাবেচার ক্ষেত্রে। এখন যদি আসি কোন উদ্যোগের ক্ষেত্রে, যেমন, আমি একটি মুরগীর ফার্ম দিলাম। প্রথমে আমাকে মুরগীর বাচ্চা কিনতে হবে। একটা ঘর নিতে হবে। মুরগীর বাচ্চাগুলোর লালন পালন করতে হবে, যত্ন নিতে হবে, বড় করতে হবে, রোগ হলে চিকিৎসা করতে হবে। এই অবস্থায় মুরগীর বাচ্চাগুলো মরে যেতে পারে, চুরি হয়ে যেতে পারে। সেই খামার ঘর বন্যায়, জ্বলোচ্ছাসে, ঝড়তুফান, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অনেক রিস্ক এলিমেন্ট আছে এখানে৷ আমি এতে প্রথমে টাকাও ইনভেস্ট করেছি, শ্রমও দিচ্ছি এবং রিস্কও নিচ্ছি৷ কাজেই সেই মুরগীর বাচ্চাগুলো যখন বড় হবে সেগুলো বিক্রিলব্ধ পাওয়া অর্থে যে লাভ হবে সেই লাভ আমার জন্য হালাল।

সূদের ক্ষেত্রে এমন কিছুই নেই, কোন রিস্ক নেই, কোন শ্রম নেই৷ আপনি ১০০ টাকা নিলেন সূদী মহাজন অথবা ব্যাংকের নিকট হতে ধার। আপনি সেই টাকা নিয়ে ব্যবসা করেন কিংবা খেয়ে ফেলেন, লাভ হোক কিংবা লস, বছর শেষে আপনি তাকে শতকরা ১০ টাকা কিংবা ২০ টাকা যতই হোক নির্দিষ্ট হারে মূল টাকার সাথে বাড়তি এই সূদ দিতে বাধ্য। এই বাড়তি টাকাটা ইসলাম বলছে হারাম। কারণ আপনি সূদী মহাজন হিসেবে কোন রিস্কও নেন নাই, শ্রমও দেন নাই। ইসলাম এই অলসতাকে মোটেও পছন্দ করে না৷ এতে করে সমাজের বিত্তশালীরা ফুলেফেঁপে আরো ধনী হয়ে ওঠবে। সমাজের হাতেগোনা কিছু মানুষ ধনী থেকে ধনী হবে। গরীবরা গরীব থেকে আরো গরীব হবে। এটা জুলম।

এখন আসুন ইসলামিক ব্যাংকের ক্ষেত্রেঃ
সূদী Conventional ব্যাংকগুলোর অলটারনেটিভ হিসেবে ইসলামিক ব্যাংককে ইসলামিক হতে হলে উপরে বর্ণিত পদ্ধতিতে হয়ত পণ্য বিক্রেতা কিংবা ব্যবসায়ী হতেই হবে। এছাড়া দ্বিতীয় কোন রাস্তা নেই প্রফিট ভোগ করার।

আদর্শ ইসলামী ব্যবসা বা উদ্যোগ (Entrepreneurship) পদ্ধতি হচ্ছে দুটো।
১. মুশারাকা ও ২. মুদারাবা।
খুব সহজে বলতে গেলে মুশারাকা হচ্ছে, এমন একটি জয়েন্ট ভ্যাঞ্চার যেখানে সকল পার্টনাররা শ্রম দিবে এবং অর্থ বিনিয়োগ উভয়টিই করবে। যা প্রফিট হবে তা পূর্ব নির্ধারিত হারে ভাগ করে নেবে নিজেদের মাঝে। লস হলে সমানভাবেই লসের দায়ও নেবে সকল পার্টনার। এখানে সকল পার্টনার টাকাও বিনিয়োগ করছে, লসের রিস্ক নিচ্ছে এবং শ্রমও দিচ্ছে।

মুদারাবা হচ্ছে, যেমন আম্মাজান খাদিজাতুল কুবরা রা. প্রিয় নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামাকে তাঁর ব্যবসার ভারাভার দিয়েছিলেন মুদারিব বা এজেন্ট নিয়োগ পদ্ধতিতে। অর্থ, বাহন, শ্রমিক সব আম্মাজান খাদিজাতুল কুবরা রা. এঁর, আর শ্রম হুজুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার। যদি লাভ হয় তবে পূর্ব নির্ধারিত হারে সেই লাভ পূজি বিনিয়োগকারী এবং মুদারিব বা এজেন্টের মাঝে তা ভাগ হবে। আর লস হলে তার দায় সম্পূর্ণ পূজি বিনিয়োগকারীর। এখানে টাকার মালিক পূজি বিনিয়োগ করছে এবং লসের রিস্কও নিচ্ছে। আর এজেন্ট বা মুদারিব শ্রম দিচ্ছে। কাজেই প্রফিট খাওয়া সবার জন্য হালাল।

কিন্তু আপনি যদি ইসলামিক ব্যাংকগুলোর ট্রানজেকশন ঘেটে দেখেন তবে পাবেন যে, সবগুলো ইসলামিক ব্যাংক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে, এই দুটো ব্যবসা পদ্ধতি প্রায় সম্পূর্ণরুপে ত্যাগ করেছে, কোন ইসলামিক ব্যাংকেরই ১% ও হবে না এই দুটো ব্যবসায় বিনিয়োগ৷ কারণ এগুলো করতে গেলে খরচ বেড়ে যায়, রিস্ক ফ্যাক্টর বেড়ে যায়। অনেক মানুষকে রাখতে হবে এই ব্যবসাগুলো পরিচালনা করার জন্য। মানুষ মিথ্যা বলতে পারে টাকা নিয়ে যে, আমার লস হয়ে গেছে। বাস্তবে লাভ হলেও কাগজে কলমে দেখাবে যে লস হয়েছে। কাজেই অনেক রিস্ক৷ আর ব্যাংককে একটিভ পার্টনার হয়ে ব্যবসা করতে গেলে অনেক লোকবল নিয়োগ দিতে হবে। এতে বছর শেষে লাভের পরিমাণ কমে যাবে। কারণ বিশাল লোকবলের পেছনে অনেক টাকা খরচ হয়ে যাবে। এরকম অনেক কারণে ইসলামিক ব্যাংকগুলো এই দুটো ব্যবসা পদ্ধতিতে নাই।

তো আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এত লাভের আশা করলে ইসলাম কিভাবে প্রতিষ্ঠা হবে? আপনারা মানুষকে আশ্বাস দিচ্ছেন সূদের বিকল্প দেবেন। মানুষের অর্থনৈতিক জীবনকে ইসলামিক করবেন। সেখানে বেনিয়াসূলভ মনমানসিকতা নিয়ে কিভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করবেন? রিস্ক নেয়ার সময় আপনারা নেই, শ্রম দেয়ার সময় আপনারা নেই, শুধু প্রফিট মেক্সিমাইজেশনের চিন্তা। আপনি ইসলামিক ব্যাংকের মালিক ও কনভেনশনাল ব্যাংকের মালিকের, মনমানসিকতাতে তাহলে পার্থক্য কী রইল?

যাইহোক, উপরোক্ত কারণে সব ইসলামিক ব্যাংক মুশারাকা ও মুদারাবা থেকে সড়ে এসে বিনিয়োগ সাইডে সম্পূর্ণরুপেই বলা যায় মুরাবাহাতে চলে এসেছে। মুরাবাহা কী? sale on credit, বাকিতে বিক্রি। এটা জায়েজ। মুরাবাহার আদর্শ সিস্টেম হচ্ছে, আপনার যদি কোন পণ্যের প্রয়োজন হয়, হতে পারে সেটা গৃহস্থালী কিংবা ব্যবসার পণ্য, আপনি ব্যাংকের কাছে গেলেন, ব্যাংক আপনাকে সেই পণ্যটি কিনে দেবে। ধরুন, বাজার থেকে ব্যাংক সেটা ১০০ টাকা দিয়ে কিনল, আপনার কাছে সেটা ১২০ টাকা দিয়ে বিক্রি করল। সেই ১২০ টাকা আপনি সমান ১২ টি ইন্সটলমেন্টে বা কিস্তিতে ব্যাংককে পরবর্তী ১ বছরে ফেরত দিলেন। এটা হচ্ছে আদর্শ মুরাবাহা। এটা জায়েজ আছে। আর ক্রেডিটে মাল কিনলে তার মূল্য একটু বেশিই হয়। এতেও কোন অসুবিধা নেই। হাদিসে এর প্রতি সুস্পষ্ট ইংগিত আছে।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই মুরাবাহাকেও ব্যাংক মালিকেরা নিজেদের মত করে মডিফাই করে নিয়েছেন, খরচ কমানোর জন্য এবং রিস্ক এড়ানোর জন্য। এতে আরো এমন কিছু সূক্ষ এলিমেন্ট যুক্ত হয়েছে যার কারণে তা আর ইসলামিক থাকে না৷

প্রথমত, আমরা যা বলেছিলাম কেনাবেচার বিষয়ে মনে আছে প্রিয় পাঠক? লাভ খাওয়া কেন জায়েজ হয়? কারণ আমি এটাতে শ্রম দিচ্ছি, বাজারে যাচ্ছি কিনছি, নিজের শোরুমে তুলছি এবং মাল নষ্ট হওয়া, চুরি যাওয়ার রিস্ক নিচ্ছি। কারণ আমি মালিকানা লাভ করার পর সেই পন্যটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে, চুরি হতে পারে ইত্যাদি এবং আমি সেইসাথে অর্থ বিনিয়োগ করছি। এখন ইসলামিক ব্যাংকগুলো কি করেন?

নিজেদের লোক পাঠিয়ে সেই পণ্য ক্রয় করেন? মালিকানা হাসিল করেন? রিস্ক নেন? ৯৫% ক্ষেত্রেই না। আইওয়াশের জন্য ৫% করলেও করতে পারেন। তো তারা কী করেন? ওই যে বলেছিলাম নিজেদের মত করে মডিফাই করে নেয়া। তারা যেই ব্যক্তি পণ্য ক্রয় করার জন্য ব্যাংকের কাছে গিয়েছেন তাকেই এজেন্ট নিয়োগ করে দেন। যান আপনি এই টাকা নিয়ে যান, বাজার থেকে কিনুন এবং আমাদেরকে রশিদ দিয়ে দিন। সেই ব্যক্তি বানোয়াট কিছু রশিদ এনে দিয়ে দিল আর সেই টাকা তার যে কাজে ইচ্ছা ব্যায় করল। ব্যাস, কাগজে কলমে সেই কেনাবেচাটা মুরাবাহা হিসেবে পরিগনিত হল। এতে করে ঋণগ্রহীতাও খুশি। কারণ তার দরকার ছিল মূলত নগদ টাকা। আর ব্যাংক মালিকরাও খুশি। কারণ প্রতিটি ক্ষেত্রে পণ্য ক্রয় করতে যাওয়ার জন্য হিউজ পরিমাণ এক্সট্রা লোক নিয়োগ দিতে হবে। পণ্যের মালিকানা হাসিলের জন্য আপনার গো ডাউন ভাড়া নিতে হবে৷ এতে খরচ অনেক বেড়ে যাবে। আর বছর শেষে লাভের পরিমাণ কমে যাবে। কিন্তু কেনাবেচার লাভ খাওয়ার ক্ষেত্রে যে কোনভাবেই Ownership retain না করলে অর্থ্যাৎ মিলকিয়ত হাসিল না করলে জায়েজ হয় না, সেই বিষয়টিকে সম্পূর্ণ অবহেলা করে হালালকে হারাম করে ফেলা হচ্ছে।সেটি জেনেও না জানার ভান করছেন ব্যাংক মালিক ও শরিয়া অডিটররা তথাকথিত “বাস্তববাদীতা”র নামে।

এখানেই যদি শেষ হত তবুও কথা ছিল। এখানেই শেষ না। কথা আরো আছে। প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কনভেনশনাল বা সূদভিত্তিক। সেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক কনভেনশনাল বা সূদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর জন্য যে সূদের হার ফিক্সড করে দেয়। সেই সূদের রেইটকেই বেঞ্চমার্ক ধরে প্রফিট রেইট বলে চালিয়ে দিচ্ছে ইসলামিক ব্যাংকগুলো। আমাদের ইসলামিক ব্যাংকগুলোর জন্য আলাদা কোন বেঞ্চমার্ক নেই প্রফিট রেইট নির্ধারণের জন্য। প্রিভেলেন্ট ইন্টারেস্ট রেইট লাইবর ক্লাইবরকে প্রফিট মার্জিন বানালে যাহা ঘাড় তাহাই গর্দনা থেকে যায়। অর্থ্যাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক (বাংলাদেশ ব্যাংক) যদি বলে যে, ব্যাংকিং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শতকরা ১০ টাকার বেশি সূদ ঋনগ্রহীতার নিকট থেকে ব্যাংকগুলো নিতে পারবে না। তো ইসলামিক ব্যাংকগুলোও সূদের সেই শতকরা ১০ টাকা হারকেই ব্যাঞ্চমার্ক ধরে মুরাবাহার ভিত্তিতে লেনদেন করতে আসা লোকগুলোকে পণ্য দিচ্ছেন বা এজেন্ট বানিয়ে টাকা দিচ্ছেন। যা ক্রেতা ইন্সটলমেন্টে পরবর্তী ১২ মাসে, উদাহরণ স্বরুপ, কিস্তিতে ফিরিয়ে দিচ্ছে।

আলটিমেটলি এটা কী হলো? ঘাড়ের নাম গর্দনা, যাহা লাউ তাহাই কদু।

সেটা তো গেল বিনিয়োগ সাইডে। আমানতগ্রহণের ক্ষেত্রেও একই বিষয়। যারা টাকা জমা রাখছেন তাদেরকেও সেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত সূদের হারেই প্রফিট দেয়া হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে নাম দিচ্ছেন মুদারাবার ভিত্তিতে প্রফিট। কারণ অন্যান্য কনভেনশনাল সূদভিত্তিক ব্যাংকের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে কিংবা আমানতের পরিমাণ বাড়াতে হলে, লোকজনকে আকর্ষণ করতে হলে, এই কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত সূদের রেইটকেই বেঞ্চমার্ক ধরতে হবে। আবারো যাহা ঘাড় তাহাই গর্দনা।

তবে আমানত জমাকারীদেরদেরকে তারা টাকা আমানত রাখার সময় বলেন যে, অতীতে এই পরিমাণ লাভ হয়েছে আমরা এই হারে দিতে পেরেছি, আপনাকেও এই হারেই দেব। কিন্তু ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোন আমানত জমাকারীকে বলা হয়নি যে, এ বছর আমাদের লস হয়ে গেছে। কাজেই আপনার পুরো টাকা পাবেন না কিংবা সম্পূর্ণ টাকাই লস, কাজেই লসের অংশীদারিত্ব নিন। না, এরকম নজির নেই। এরকম হলে মানুষ আর ইসলামিক ব্যাংকে টাকাই জমা রাখবে না। তবে টাকা জমা নেয়ার সময় একটা লামসাম রেইট বলে, প্রফিট দেয়ার সময় কিছুটা কম দেয়ার নজির আছে। কারণ কম দিতে পারলেই ব্যাংক মালিকদের লাভের পরিমাণ বাড়ে, যা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। অপরদিকে জমাদানকারী যদি ইসলাম সচেতন হন তবে তিনিও একটা ইম্প্রেশন পান যে, আরে এদের প্রফিট মার্জিন তো ফিক্সড না। তার মানে এটা সূদ না। ইসলামিক। আত্মতৃপ্তি পেলেন আমানত জমাদানকারীরাও।

আমানত জমাদান কারীদের আবেগ নিয়ে একটু খেলাও করা গেল, আবার নিজেদের প্রফিট মার্জিনও একটু বাড়ানো গেল। লাভের উপর ডাবল লাভ। কিন্তু বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূদের হারই তথাকথিত “লাভের” বেঞ্চমার্ক, ওখানে কোন ছাড় নেই। এটা ইসলামী নৈতিক মনমানসিকতা হল?

অনেকেই বলেন, প্রতিটি ইসলামী ব্যাংকে শরিয়াহ বোর্ডে বড় বড় আলিম উলামাগন থাকেন, শরিয়াহ অডিটর বা মুরাকিব থাকেন। তারা কী এই বিষয়গুলো বুঝেন না?

প্রিয় ভাই ও বোনেরা! হাতীর দাঁত চিনেন হাতীর দাঁত? খাওয়ার জন্য একপাটি আর মানুষকে দেখানোর জন্য আরেক পাটি থাকে? এরকমই। কাগজে কলমে অর্থ্যাৎ থিওরিটিকালি তারা সব ইসলামিক দেখায় শরীয়াহ বোর্ডকে, মুরাকিবকে। আর প্র‍্যাকটিকালি তাদের লেনদেন সূদি ব্যাংকের অনুরুপ। উলামাদেরকেও ধোকার মাঝে রেখেছে ব্যাংক মালিক ও কর্মকর্তারা৷ এটা একটা কম্পলিট ধোকার প্যাকেজ। অথবা অনেক আলিম ও মুরাকিব জেনেশুনেই এসব ওভারলুক করছেন। মাস শেষে সম্মানী তো ভালই পাচ্ছেন একেকজন। হালাল সার্টিফিকেট দিতে সমস্যা কী?

এখন অনেকেই বলতে পারেন তাহলে আপনি একটি আদর্শ ইসলামিক ব্যাংক করে সকলকে দেখিয়ে দিচ্ছেন না কেন? আরে ভাই, ১০০ কোটি টাকা ডিপোজিট দিতে হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নতুন একটি ব্যাংক করতে হলে। এটা আমার মত গরিবের পক্ষে সম্ভব?

আর যদি সম্ভব হয়ও তবুও এটাকে ১০০% ইসলামিক রাখা প্রায় অসম্ভব সার্বিক পরিস্থিতির কারণে।

কারণ, আমদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এডিবি, আই এম এফ সব সূদভিত্তিক। সেখানে ইসলামিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠা দুরুহ ব্যাপার।

আর হ্যাঁ, তাও সম্ভব অনেকটাই ইসলামিক করা, শর্ত হচ্ছে, লোভের পরিমাণ কমাতে হবে ব্যাংক মালিকদেরকে। এবছর ১০০ কোটি লাভ হলে আগামী বছর যদি ৮০ কোটিও লাভ হয় এতে মন খারাপ করা যাবে না। আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে ট্রাঞ্জেকশন যেন ইসলামিক হয়। এতে খরচ বাড়বে। লোকবল বাড়াতে হবে। গোডাউন নিতে হবে। নিতে হলে হোক। কিন্তু মুরাবাহা বা ক্রেডিট সেইলকে ইসলামিক রাখতে হলে তাই করতে হবে। এ বছর ১০০ কোটি প্রফিট করে এর পরের বছর ব্যাংক টার্গেট নেয় ১২০ কোটি লাভ করতে হবে। এই বেনিয়াসুলভ মনমানসিকতা নিয়ে ইসলামিক ব্যাংকিং এ ইসলামিক স্ট্যান্ডার্ড এস্টাব্লিশ করা সম্ভব না। হ্যাঁ, সাধারণ মানুষের আবেগের সাথে খেলা করা যাবে। কারণ এখন ইসলাম শব্দটাই একটা হট কেইক। যে যেভাবে পারে এই নামকে বিক্রি করছে।

আর আদর্শ ইসলামিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করতে হলে উদ্যোক্তাদের সাথে একটিভ পার্টনারশিপে যেতে হবে মুশারাকার ভিত্তিতে। যা করতে কোন ইসলামিক ব্যাংক রাজিই না। ওদিকে চিন্তা করাও এখন বন্ধ করে দিয়েছে।

সূদী ব্যাংকগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে কিছু কিছু ইসলামিক ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড বের করেছে। কিভাবে? এটা পিওর সূদ ছাড়া আর কিছুই নয়৷

একবার দেখলাম একটি নামকরা ইসলামিক ব্যাংক তাদের একটি স্কিমের নাম দিয়েছে “মুদারাবা ডাবল বেনিফিট স্কিম”। সূদী ব্যাংকে একই স্কিমের নাম “ডাবল বেমিফিট স্কিম”! সাথে শুধু মুদারাবা শব্দটা এক্সট্রা লাগিয়ে দিয়েছে ইসলামিক ব্যাংক। আপনি এই স্কিমের আওতায় আমানত জমাকারীদেরকে নামের মাঝেই গ্যারান্টি দিচ্ছেন, যা টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করবেন তার ডাবল ৬ বছর পর পাবেন৷ তো আপনার আর সূদী ব্যাংকের মাঝে পার্থক্য কী? The difference is only in name.

ভেতরের এরকম প্রতিটি বিষয় নিয়ে আলোচনা যদি করতেই থাকি তবে একটা পুরো বই হয়ে যাবে। এজন্য এখানেই থামলাম।

এসমস্ত কারণে ইসলামিক ব্যাংকিং এর প্রবক্তা যারা ছিলেন তাদের অনেকেই যেমন, শায়খ মুফতি তাকি ওসমানী সাহেব সহ যারা ইসলামিক ব্যাংকিং এর সাথে শুরু থেকেই জড়িত ছিলেন, তারা অনেকেই অনেক সময় হতাশ হয়ে স্পষ্টভাবে বলেছেন, The concept of Islamic banking has been hijacked by some bankers.
ব্যাংক মালিকরা ইসলামিক ব্যাংকিং এর মূল থিমকে হাইজেক করে ফেলেছে।

এত এত অনিয়ম ও আনইসলামিক কাজ হওয়ার পরও যদি আমাদের উলামায়ে কেরাম ইসলামিক ব্যাংকিং কে জায়েজ বলতে পারেন তবে যারা কনভেনশনাল সাধারণ ব্যাংকিংকে জায়েজ বলেন তারা দোষ কি করেছেন?

মিসরের সাবেক শায়খুল আজহার ড. সায়্যিদ মুহাম্মদ তানতাভি, সাবেক গ্র‍্যান্ড মুফতি ড. আলি জুমুয়াসহ এই যুগের কোন কোন বড় স্কলার সাধারণ কনভেনশনাল ব্যাংকিংকেই জায়েজ বলেছেন। তাদের কাছে ইসলামিক ব্যাংকিং ও সাধারণ ব্যাংকিং একই বিষয়৷ কোন পার্থক্য নেই।

তাঁদের যুক্তি, এই ব্যাংকিং ব্যবস্থা হুজুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার সময়ে ছিল না। এটা সম্পূর্ণ নতুন একটা বিষয়। সাধারণ ব্যাংক হোক আর ইসলামিক ব্যাংক তারা টাকা জমা নিচ্ছে, সেই টাকা অন্যদের কাছে বিনিয়োগ করছে, প্রফিট নিচ্ছে এবং সেই লাভ শেয়ার করছে আমানতকারীদের সাথে। একটা অংশ ব্যাংক মালিকেরা নিজেরা রাখছে। এটা এখন সারা পৃথিবীর অর্থনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য হয়ে গেছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা ছাড়া আধুনিক জমানাতে কোন দেশের অর্থনীতি চিন্তাও করা যায় না। তাই তারা মাসলাহা মুরসালার ইস্যূটি এখানে এনেছেন। সর্বসাধারণের ব্যাপক কল্যাণের জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেয়া ছাড়া আমাদের কাছে আর কোন উপায় নেই।

কেউ কেউ বলতে পারেন, তাকওয়ার খাতিরে আমি সব ব্যাংক থেকেই দূরে থাকব। সবই যদি সূদ হয়। হ্যাঁ প্রিয় ভাই ও বোনেরা! আপনি একা দূরে থাকতে পারেন। কিন্তু পুরো দেশের সবাই কী পারবে ব্যাংক থেকে দূরে থাকতে? দেশ কি পারবে রাষ্ট্র হিসেবে ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে দূরে থাকতে? ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে কোন দেশ দূরে সড়ে আসলে ঐ দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। আর আপনি চান বা না চান একটা দেশের নাগরিক হিসেবে আপনি সিস্টেমেরই অংশ। এ থেকে কোন মুক্তি নেই।

ওয়াল্লাহু ওয়া রাসূলুহু আ’লামু বিস সাওয়াব। আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হক ও বাতিল সম্পর্কে অধিক অবগত।

লেখকঃ সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া আজহারী,
এম এ, ইসলামিক ব্যাংকিং ফাইন্যান্স এন্ড ম্যানেজমেন্ট, ইউনিভার্সিটি অফ গ্লোস্টারশায়ার, ইংল্যান্ড।

মাস্টার্স এর থিসিসের শিরোনামঃ “A critical analysis of the problems and the challenges in the current Islamic banking practice in Bangladesh.”

নিজস্ব প্রতিবেদক https://khoborbangla24.net

বিশ্বজুড়ে দেশের খবর

You May Also Like

More From Author

+ There are no comments

Add yours