সুন্দরবনের নদী খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের প্রবণতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এক শ্রেনীর অসাধু জেলেরা অবাধে বনের ভেতরের নদী খালে রিপকর্ড বিষ ঢেলে দিয়ে চিংড়ি মাছ নিধনে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
বিষক্রিয়ায় আক্রন্ত হয়ে অন্যান্য প্রজাতির মাছও সমূলে নিধন হচ্ছে। ফলে সুন্দরবনে আগের মতো চিংড়ি সহ অন্যান্য প্রজাতির মাছের দেখা মিলছে না। ব্যাবস্থা গ্রহন করা না গেলে হুমকির মধ্যে পড়বে মৎস্য সম্পদ।
কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না সুন্দরবনের আশপাশের নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার। ফলে সুন্দরবনের মৎস্যভান্ডার নদী-খাল ক্রমশ-ই মাছশূন্য হয়ে পড়ছে। বিষ প্রয়োগ করায় শুধু মাছ-ই নয়, মারা যাচ্ছে অন্যান্য জলজ প্রাণীও। এতে একদিকে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বনজ সম্পদসহ পরিবেশের ওপর।
অন্যদিকে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের। এই অবস্থায় জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষায় দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান বন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র বাগেরহাট জেলার আহবায়ক সাংবাদিক নুর আলম শেখ বলেন, খালে/নদীতে বিষ দেওয়ায় শুধু মাছ নয়, পানি বিষাক্ত হয়ে অন্যান্য জলজ প্রাণীও মারা যাচ্ছে। বিষ দিয়ে মাছ শিকার করায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, কীটনাশক দিয়ে মাছ ধরায় শুধু সুন্দরবনের মৎস্যসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, এই বিষাক্ত পানি পান করে বাঘ, হরিণ, বানরসহ অন্য বন্য প্রাণীরাও মারাত্মক হুমকির মধ্যে রয়েছে। এতে উপকূলীয় এলাকায় মানুষের পানীয় জলের উৎসগুলোও বিষাক্ত হয়ে পড়ছে বলে জানান বাপার এই নেতা। জেলেদের সুত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের ভেতরের অন্যান্য নদী খালে পাশ পারমিট ছাড়া অসাধু জেলেরা বিষ প্রয়োগ করে নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছ শিকার অব্যাহত রেখেছে।
মোংলা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার শতাধিক জেলে বর্তমান সুন্দরবনে বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকারের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। জেলেরা বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকেই সুন্দরবনের নদী-খালে মাছ ধরে আমাদের জীবিকা চলে। এই মাছ-ই আমাদের সব। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বনে বিষ দিয়ে মাছ শিকার বেড়েছে।
তারা আরও জানান, প্রথম দিকে অল্প কিছু খালে বিষ দিলেও দিন দিন তা ভয়ংকর ভাবে বাড়ছে। আমাদের মতো সাধারণ জেলেদের ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। আমরা না-পারি বিষ দিতে না-পারি ভালোভাবে মাছ ধরতে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকার একাধিক জেলে জানান, বন বিভাগের অজান্তে বিষ দিয়ে মাছ শিকার কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এর সাথে বনের কেউ না কেউ অবশ্যই জড়িত রয়েছে। এই কথা বললে আবার মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। বিষ প্রয়োগের কারণে সাধারণ জেলেরা তেমন মাছ পান না। বিষ দিয়ে মাছ শিকারের দায়ে জেল থেকে ছাড়া পাওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মোংলা চিলা এলাকার এক জেলে বলেন, কয়েক বছর আগে থেকে ব্যবসায়ীদের পরামর্শে মাছ ধরতে বিষ প্রয়োগ করা শুরু করি। আমরা বেশির ভাগ সময় বিষ দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরি।
তিনি আরও বলেন, অল্প সময়ে বেশি মাছ পাওয়া যায়। তবে বিষ দিলে অন্য অনেক মাছের ক্ষতি হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ কাজ করলেও আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। পরিবর্তন হয় বড় বড় মহাজনদের।
এক ধরনের অসাধু জেলেরা জোয়ার পরিপূর্ণ হলে খালের নিচভাগে ভেষালি জাল পেতে দিয়ে খালের অগ্রভাগের পানিতে রিপকর্ড সহ ভারতীয় বিভিন্ন বিষ বোতল থেকে ছিটিয়ে দেয়। ভাটা শুরু হলে খালের ওপরের অংশের পানি দ্রুত খালের নিচের দিকে ধাবিত হতে থাকে।
ফলে অগ্রভাগ থেকে নিচ পর্যন্ত খালের ছোট বড় সমুদয় মাছ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মরে লালচে আকার ধারন করে ভেষালি জালে এসে জড়ো হতে থাকে। অধিক মাছ জালে জড়ো হওয়ায় অসাধু জেলেরা তখন মাছ গুলো ধরে নেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুই জেলে জানিয়েছে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করে আমরা বেশ লাভবান হচ্ছি। কারন হিসেবে তারা জানায় বিষ না দিলে জালে বেশি মাছ পড়ে না, আর বিষ প্রয়োগে ছোট বড় সকল প্রজাতির সব মাছ জালে জড়ো হয়।
জেলেরা আরো জানায় সচরাচর তারা কীটনাশকের দোকান থেকে রিপকর্ড বিষ ক্রয় করে। গত ৬/৭ দিন আগে কোন ধরনের পাস পারমিট ছাড়া গোপনে একদল দুর্বৃত্ত সুন্দরবনের উরুবুনিয়া খালে বিষ দেয়। দুর্বৃত্তদের দেওয়া বিষে মাছ মরে খালের বিভিন্ন জায়গায় ভেসে ওঠে।
এ ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে বনবিভাগ। কমিটির প্রধান করা হয়েছে চাঁদপাই স্টেশন কর্মকর্তা ওবায়দুর রহমানকে। অপর দুই সদস্য হলেন জোংড়া টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন ও চাঁদপাই রেঞ্জ কার্যালয়ের ফরেস্টার মিজানুর রহমান। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হলেও কোন অগ্রগতি দেখা যায়নি।
এর আগে গত মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সুন্দরবনের হারবাড়িয়া ভেড়ির খাল এলাকা থেকে সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের অভিযোগে আট জেলেকে আটক করেছে বন বিভাগ। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৩টি কাঠের নৌকা, চারটি জাল ও দুই বোতল কীটনাশক (বিষ) জব্দ করা হয়েছে। পরে বন আইনে মামলা দায়ের তাদের বাগেরহাট আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়।
ষ্টেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা উৎকোচের বিনিময় অবৈধ ভাবে জেলেদেরকে সুন্দরবনে ঢুকতে দিয়েই এ ক্ষতি সাধন করছে বলে অভিযোগ জেলেদের। মোংলা সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার মোঃ জাহিদুল ইসলাম বলেন,বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরা দন্ডনীয় অপরাধ,বিষ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করা না গেলে মৎস্য সম্পদ হুমকির মধ্যে পড়বে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের চাঁদপাই ষ্টেশন কর্মকর্তা ওবায়দুর রহমান বলেন, তদন্ত কাজ চলতেছে, উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অফিসে নাইতো! পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, বিষ প্রয়োগে মাছ শিকার করা গুরত্বর অপরাধ। বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরা জেলেদের আটক করতে বন বিভাগ সব সময় সতর্ক। বিষ দিয়ে মাছ শিকারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমাদের প্রতিটি ক্যাম্প ও স্টেশনের বনরক্ষীদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে।
আলী আজীম, মোংলা (বাগেরহাট)
+ There are no comments
Add yours