মা ইলিশ রক্ষা এবং প্রজনন মৌসুম নির্বিঘ্ন করতে ইলিশ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা গত ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে। আর এ নিষেধাজ্ঞায় উপকূলের জেলেদের কপালে পড়েছে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। আগের নিষেধাজ্ঞার সময়গুলোতে রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জেলেরা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর দিন কাটান। মায়েরা প্রয়োজনীয় খাবার না পাওয়ায় দুগ্ধপোষ্য শিশুরাও দুধের কষ্টে ভোগে।
এ নিষেধাজ্ঞার সময় সরকার যে খাদ্যসহায়তা দেয়, তা সব জেলে পান না। আবার চাহিদার তুলনায় খুব চাল দেওয়া হয়। এ সহায়তা বিতরণেও রয়েছে নানামুখী অনিয়ম। তাই এ সময় বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান না থাকায় জেলেরা পরিবার নিয়ে ভীষণ কষ্টে দিন কাটান।
প্রায় সারাবছরই সমুদ্র ও সুন্দরবন ঘেষা নদ-নদীতে মাছ ধরে জীবন নির্বাহ করেন মোংলাসহ উপকূলীয় জেলেরা। মাছ ধরেই চলে তাদের সংসার, ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া। এর মধ্যে প্রাকৃতিক দূর্যোগসহ মাছ ধরার ওপর যখন নিষেধাজ্ঞা আসে জীবন থমকে যায় তখন। এসময় অন্য কোন পেশায় সুযোগ না পেয়ে তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে অলস বসে থাকতে হয়। সরকারি ত্রানের সুবিধা পেলেও চাহিদার তুলনায় কম হওয়ায় তাদের জীবনে একরকম নির্মম পরিস্থিতির তৈরি হয়। ভেবে
পাননা তখন কি করবেন! তাদের নিয়ে কেউ ভাবেও না। এমন জেলে জীবনের বাস্তবত চিত্র ফুটে এসেছে তাদের সাথে কথা বলার পর।
জেলেরা বলছেন, বছরজুড়ে নিষেধাজ্ঞা চলাকালে সরকার নামমাত্র চাল সহায়তা দিলেও তা অধিকাংশ জেলে পান না। অনেকে জেলে নন, তাঁরাও এ সহায়তা পাওয়ায় প্রকৃত জেলেরা বঞ্চিত হন। এ নিষেধাজ্ঞার জাঁতাকলে তাই ধারদেনায় বছর বছর জর্জরিত উপকূলের জেলেরা।
শুক্রবার (১৪ অক্টোবর) সরেজমিনে গিয়ে এই প্রতিবেদকের সংঙ্গে কথা হয়, মোংলা উপজেলার চাঁদপাই ইউনিয়নের কাইনমারী গ্রামের জেলে মোঃ রশিদ (৪২), রিংকু সরদার (২৮), চিন্ময় ঢালী (২৫) ও সিমন বিশ্বাস (৩৫) এর সাথে। অত্যান্ত হতাশার সুরে তারা বলেন-‘জীবনাটাই শেষ হলো নদীর নোনা পানি আর সমুদ্রের ভয়ংকর ঢেউয়ের সাথে। পেশায় জেলে তাই অন্য কোন উপায় নাই, মাছ ধরার ওপর নির্ভর জীবন। এই দিয়ে চলে সংসার। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়াও ঠিকমত করাতে পারিনা’!
এসব জেলেরা বলেন, মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির পর মরার ওপর যেন খাড়ার ঘাঁ চলে আসে। এই সময়ে সরকারি যে ত্রান দেওয়া হয় তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। এদিয়ে সংসার চলেনা। তাহলে কি চান জানতে চাইলে-এসব জেলেরা বলেন, এখন
ইলিশ ধরার ওপর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলেছে। এই ২২ দিনের জন্য শুনেছি ২৫ কেজি চালের বরাদ্দ হয়েছে, তবে এখন (১৪ অক্টোবর) পর্যন্ত পাইনি। তাদের দাবি এই ভিজিএফর চালের পরিমান আরও বাড়িয়ে ৪০ কেজি করা হোক। পাশাপাশি সরকার যেন তাদের আর্থিক সহায়তা দেন।
চিলা ইউনিয়নের জয়মনি গ্রামের জেলে ডি এল মন্ডল (৫৫), স্বপন মন্ডল (৪২), আফজাল শেখ (৬০) ও আসাদ হাওলাদার (৫৫)। ৩০ বছর ধরে পশুর নদীতে তারা ইলিশ মাছ ধরেন। অন্য কোন পেশায় জড়াতে পারেন না। এখন নিষেধাজ্ঞার সময় কি করছেন তারা ? কি চান, জানতে চাইলে তারা বলেন-‘পরিবার পরিজন অলস বসে আছি। খুবই কষ্টে আছি, সরকারিভাবে যে চাল পাই তা খুবই সামান্য, সত্যিকার অর্থে এ দিয়ে জীবন চলেনা’! নিষেধাজ্ঞার সময়ে সরকার আমাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের পাশাপশি স্বল্প সুদে যদি ঋন দিত তাহলে ভাল ভাবেই জীবন পার করতে পারতাম’।
জাতীয় মৎস্যজীবি সমিতির মোংলা উপজেলার সভাপতি বিদ্যুৎ মন্ডল বলেন, ‘আমাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নিবন্ধিত মৎস্যজীবিদের সন্তান ও পোষ্যদের জন্য ১০ শতাংশ কোঠা সংরক্ষন, প্রশিক্ষিত ব্যক্তিকে জামানত বিহীন সুদ মুক্ত লোন প্রদানের ব্যবস্থা করা, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষন কেন্দ্র স্থাপন, উপকূলীয় অঞ্চলসহ সকল চরাঞ্চল এলাকায় মৎস্য পল্লী নামে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলাসহ ১১ দফা প্রস্তাবনা সরকারের মৎস্য দফতরে প্রণয়ন করা হয়েছিল। এর মধ্যে দু’ একটি বাস্তবায়ন হলেও বাকি দাবিগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। এ দাবি বাস্তবায়ন হলে মৎস্যজীবিদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনমাত্রার মান পরিবর্তন করা সম্ভব বলেও জেলে বিদ্যুৎ মন্ডল জানান।
জেলেদের এ দাবির কথা স্বীকার করে মোংলা উপজেলা জেষ্ঠ্য মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, মোংলায় হালনাগাদ নিবন্ধিত জেলে রয়েছে পাঁচ হাজার ৮৬৬ জন। আর অনিবন্ধিত রয়েছে সাত হাজার জেলে। এদের মানোন্নয়নে সরকার যথেষ্ট আন্তরিক রয়েছে। ইতোমধ্যে মোংলা পৌর শহরের সিগনাল টাওয়ার এলাকায়, উপজেলার চিলা ইউনিয়নের কেয়াবুনিয়া, সুন্দরতলা ও আমতলা এবং চাঁদপাই ইউনিয়নের কালিকাবাড়ী, কাইনমারী ও সোনাইলতলা ইউনিয়নের উলুবুনিয়ায় বিশ্ব ব্যাংক মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে জেলেদের জন্য একটি প্রজেক্টের অধীনে কাজ করছে। এই প্রজেক্টে শুধু জেলেদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এই প্রজেক্টের মাধ্যমে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার লোনও দেওয়া হয়েছে। সেই লোনের আট শতাংশ লাভ্যাংশের টাকাও এই জেলেদের মাধ্যে ভাগ করে দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এছাড়া জেলেদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য কাজ করা হচ্ছে বলেও জানান এই মৎস্য কর্মকর্তা।
+ There are no comments
Add yours