ইয়াসির আরাফাত তূর্য
স্বাধীনতার ৫১ বছর পরেও যদি বাংলাদেশের মাটিতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা অবহেলিত হয় তখন গুমরে কেঁদে ওঠে লাখো শহীদ দামাল ভাইয়ের, বীরাঙ্গণা বাঙালি মায়ের পবিত্র আত্মা, রক্তস্নাত স্বাধীনতার রক্তিম পতাকা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অপারেশ জ্যাকপট সম্পন্ন ব্যতিত বাঙালির বিজয় অর্জন অসম্ভব ছিলো। সমস্ত প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে সংসার ও জীবনের মায়া ভুলে নিশুতি রাতের আধার পেরিয়ে উত্তাল সাগরের বুক চিরে স্বাধীনতার দীপ্ত সূর্য এনে দেয়া মৃত্যুঞ্জয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধা অপারেশন জ্যাকপটের ডেপুটি কমাণ্ডার মোহাম্মদ আবদুল গফুর আজ জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে উপনীত। রাষ্ট্রের অবহেলায় আজ তিনি প্রায় বিনা চিকিৎসায় পড়ে আছেন হাসপাতালের দেউড়িতে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছে এই মহান সন্তানকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান প্রদর্শনের দাবি জানাই। বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌ-কমান্ডো আব্দুল গফুর (০০০২১) সম্পর্কে এই নিবন্ধে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো। তিনি সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৬৮ সালে যশোর জেলা ছাত্রলীগের সাহিত্য ও ক্রিয়া বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭১ সালে শার্শা থানা সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। শার্শা থানা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকের পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডো এসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি ১৯৬৯ গণঅভ্যত্থানে লিফলেট বিতরণসহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ এ নির্বাচনে এমএলএ মশিউর রহমানের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং অপারেশন জ্যাকপটেও অংশ নেন। পরবর্তীতে হিরণ পয়েন্টে মাইন আক্রমণ, চালনা বন্দরে মাইন, লালশিরা জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া সহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক অপারেশনে বীরত্বের সাথে অংশ নেন ও ডেপুটি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অধীনে সম্পন্ন অপারেশনে ২৬ টি পাকিস্তানি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়, তিনি নিজ হাতে ৮ টি পাকিস্তানি জাহাজে মাইন সংযুক্ত করে ডুবিয়ে দেন। ১৯৭৮ এ আওয়ামী লীগের চরম দুর্দিনে শার্শা থানা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আওয়ামীলীগকে সংগঠিত করেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা নেভাল কমান্ডো আব্দুল গফুরের পরিবার ৭৫ পরবর্তীকালে স্বাধীনতা বিরোধীদের অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। কর্মজীবনে তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বিএনপি জামায়াতের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে শিক্ষকতা পেশা ছাড়তে বাধ্য হন। পরবর্তীতে জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথে গণতন্ত্র পুনোরুদ্ধারের কাজ শুরু করেন। বহু আন্দোলন সংগ্রামের পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে দেশের উন্নয়নের কাজে মনোযোগ দেন। যশোরের শার্শার তৎকালিন এমপি তবিবর রহমানের সাথে এলাকায় স্কুল কলেজ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাসহ অনেক উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন করেন।
এছাড়াও, তিনি ২০১০ সালে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে গঠিত মামলায় যশোরের শার্শা উপজেলার ১ নম্বর সাক্ষী ছিলেন।
১৯৭১ এর এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বর্তমানে ডায়াবেটিস, কিডনী, শাসকষ্ট এবং চোখের জটিলতা নিয়ে বারডেম জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নির্মাতা হয়েও রাষ্ট্রের অবহেলায় তিনি আজ উন্নত চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। যথাযথ চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুপথযাত্রী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডো আব্দুল গফুরের পাশে দাঁড়ানো রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করি।
পারিবারিক জীবনে দুই ছেলে তিন মেয়ের জনক। তার স্ত্রী শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর গ্রহন করেছেন৷ দুই ছেলের বড় ছেলে ব্যবসা এবং ছোট ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পেশার সাথে জড়িত হলেও নব্য হাইব্রিড আওয়ামী লীগের রোশানলে পড়ে বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছেন।
প্রসঙ্গত, বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডো আব্দুল গফুরের কনিষ্ঠ পুত্রকে বিনা দোষে ষড়যন্ত্র করে চাকরিচ্যুত করায় তাঁর পরিবার এখন অসহায় হয়ে পড়ায় তাদের পক্ষে উন্নত চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন সম্ভব নয়। জাতির সূর্যসন্তান নৌকমান্ডো আব্দুল গফুরের মত একজন রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েও যথাযথ চিকিৎসার অভাবে মারা গেলে জাতি হিসেবে আমাদের জন্য তা হবে চূড়ান্ত লজ্জার।
রাষ্ট্রের জন্য তা চরম ব্যর্থতা হিসেবে পরিগণিত হবে। বর্তমান বাস্তবতায় বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডো আব্দুল গফুরের উন্নত চিকিৎসার জন্য জরুরি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। এ দেশ ও জাতির ইতিহাসের দায়বদ্ধতাকে উপলব্ধি করে নৌকমান্ডো বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গফুরের পাশে দাঁড়ানো সরকারের দায়িত্ব এবং কর্তব্য। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নির্মাতাদের একজন জীবন্ত প্রতিনিধি হিসেবে আব্দুল গফুরের মত অবহেলিত বীর মুক্তিযোদ্ধার সামগ্রিক দায় দায়িত্ব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কখনোই এড়িয়ে যেতে পারেনা।
+ There are no comments
Add yours