রংপুরে কিশোরী মৌসুমির পেটের খুদায় যেন হত্যার কারণ হয়ে গেলো

Estimated read time 1 min read
Ad1

রংপুরে পাঠশালার মোড়ে পুলিশের বিলাশ বহুল বাড়ি যেন কিশোরী মৌসুমি হত্যাকে আত্নহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার অভিযোগ ওসি মইনুলের বিরুদ্ধে। হতদরিদ্র পরিবারে জন্মনেয়া কিশোরী মৌসুমি (১৫) পেটের দায়ে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন কুড়িগ্রাম জেলায় কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তা ওসি মইনুলের এর বাসায়।

রংপুর মহানগরীর মুন্সিপাড়ায় পাঠশালার মোড়ে বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাথরুমের ছাদে মৌসুমি (১৫)নামের এক কিশোরীর মরদেহ উদ্ধার করেন পুলিশ। ওই কিশোরী মৌসুমি কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশে কর্মরত ওসি মইনুলের বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, নির্যাতন পরবর্তী হত্যা করে পুলিশ বিল্ডিং নামে পরিচিত প্রয়াস এপার্টমেন্ট এর ৬ তলা ছাদ থেকে ফেলে দেয়া হয়েছে কিশোরীর মরদেহ। এলাকাবাসী বলেন, ৫ জন পুলিশ কর্মকর্তা এবং কয়েক জন ব্যাংকার ও সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা মিলে প্রয়াস এপার্টমেন্ট নামক বিলাশবহুল এই আবাসন তৈরি করেছেন।

সেখানেই প্রায় ৭/৮ মাস যাবৎ গৃহ-পরিচারিকার কাজ করে আসছিলেন সুন্দরী কিশোরী মৌসুমী। সে রংপুর সদর উপজেলার ৩ নং চন্দন পাট ইউনিয়নের মোশারফ হোসেন এর মেয়ে। মৌসুমির বাবা পুর্বে থেকেই খুব সাধাসিধে ছিলেন, স্ত্রী কল্পনা আক্তারের মৃতুতে তিনি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। সে কারণেই মেয়ের মারা যাবার খবর টুকু পেয়ে ছুটে আসা বাবাকে মৃত মৌসুমির লাশটাকে দেখতে দেওয়া হয়নি হতভাগ্য পিতাকে! এমনকি জানাযায় কিংবা মাটি দিতেও দেখা যায়নি তাকে।

অনেকটা লুকোচুরি করেই শেষ কার্য সম্পাদন করেন মামা মঞ্জুরুল ও ওসি মইনুলের আস্থাভাজন ব্যক্তি সিরাজুল ইসলাম সুরুজ পিওন রংপুর সরকারি কলেজ রংপুর দারিদ্রতার ফাঁদ পেড়িয়ে স্কুলের বারান্দায় খুব একটা যাওয়া হয়নি মৌসুমির! ক্ষুধার কষ্ট নিবারনে প্রায় ৫/৬ বছর বয়সেই ঢাকায় গিয়ে গৃহপরিচারিকার কাজ শুরু করেন সে। রংপুর মহানগরীর ১২ নং ওয়ার্ড রাধাকৃষ্ণপুর মাষ্টার পাড়ার বাসিন্দা ঠিকাদার শফিকুল ইসলাম ভুট্রুর ঢাকাস্থ মোহাম্মদ পুরের বাড়িতে।

হঠাৎ করেই মামা মঞ্জুরুল এর পিড়াপিড়িতে সেখান থেকে চলে আসেন নানার বাড়ীতে। তার বিয়ের অজুহাতে ৪০ হাজার টাকাও নেন মামা মঞ্জুরুল ও তার পরিবার। পরে রাধাকৃষ্ণপুর মাষ্টার পাড়ার আ: জলিল এর পুত্র সিরাজুল ইসলাম ওরফে সুরুজ (রংপুর সরকারি কলেজে কর্মরত পিওন) এর মাধ্যমে তার পুর্ব পরিচিত ওসি মইনুলের (প্রয়াস এপার্টমেন্ট’র ২য় তলা) বাড়িতে কাজ নিয়ে দেন ৮/৯ মাস পুর্বে।

মৌসুমির খালা মমতাজ সাংবাদিকদের বলেন, ওরা তিন ভাই বোন, মৌসুমি সবার বড় ওর বয়স ছিল ১৫ বছর, মীম ৯ বছর সব ছোট ওর ভাই কবির ৭বছর বয়স। তিনি আরও জানান, মৌসুমি ছোট বেলায় সমাজ কল্যাণ এতিম খানায় তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিল। তার মা কল্পনা কুমিল্লার ভবের চড়ে থাকাকালীন সময়ে মারা যান। এবং ওখানেই তাকে দাফন করা হয়েছে।

মৌসুমির মরদেহ গোসল করিয়েছেন শাহনাজ, রোকসানা, শহর বানু, পাশে তার নানি মা হাসনা বানু উপস্থিত ছিলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাধাকৃষ্ণপুরের স্থানীয়রা জানান, ১৩ ফেব্রুয়ারী সে মারা যাবার সপ্তাহ খানেক আগে বাড়িতে চলে আসে এবং ওসি মইনুলের বাড়িতে কাজ করবে না বলে মামা মঞ্জুরুলসহ পরিবারের লোকজনদের জানায়। পরে সিরাজুল ইসলাম ওরফে সুরুজ পিওন তাকে মইনুলের বাসায় যাওয়ার জন্য ডাকতে আসলে সে যাবেনা বলে জানায় এবং কান্নাকাটিও করে।

সুরুজের চাপে তার না যাওয়ার কারণ বিস্তারিত বলার পরে, নাছোড়বান্দা সুরুজ পিওন তাকে নানাবিধভাবে প্রভাবিত করে আবার নিয়ে যায় পুলিশ কর্মকর্তা মইনুলের বাসায়। সেই যাওয়াই মৌসুমির শেষ যাওয়া! ক’দিন যেতে না যেতেই গত ১৩ ফেব্রুয়ারী সকালে তার মরদেহ মেলে রংপুর মহানগরীর মুন্সিপাড়াস্থ বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাথরুমের ছাদে। নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে রাধাকৃষ্ণপুরের একাধিক নারী পুরুষ জানান, ওসি মইনুলের স্ত্রীর পরকিয়ার বিষয় জানতো মৌসুমি! সে কারণে সে ভয়ে ছিল ওখানে যাইতে চাইত না। মৌসুমির চলে আসা, পূণরায় যাইতে না চাওয়া এবং ভয়ের মুল কারণ সুরুজ পিওন-কে বিস্তারিত বলেছিল সে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মৌসুমির এক মামা বলেন, আমার ভাগনি মৌসুমিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাকে হত্যা করে কৌশলে লাশ স্কুলের বাথরুমের ছাদে রাখা হয়েছিল, অপরদিকে মৌসুমির আরেক মামা ট্রলি ড্রাইভার মঞ্জুরুল-কে ডেকে পুলিশ একটি “মৃত্যু সংবাদ অবহিত করণ প্রসঙ্গে” শিরোনামে একটি কাগজে স্বাক্ষর নেন। সেই কাগজটা যে কেউ পড়লেই বুঝতে পারবে মৌসুমি আত্নহত্যা করেছে নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, রংপুর মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি থানা পুলিশ যেভাবে লিখে নিয়েছেন।

অথবা মঞ্জুরুল যেভাবে লিখে দিয়েছেন যে, ১৩ ফেব্রুয়ারী রাতে প্রয়াস এপার্টমেন্ট এর ছয়তলা ছাদ থেকে মৌসুমি পড়ে গিয়ে মারা গেছেন! আবার এটাও লেখা আছে সে আত্নহত্যা করেছে। তিনি আরও বলেন, মৌসুমি যদি ছয়তলা থেকে লাফ দিয়ে আত্নহত্যা করে, তাহলে যে জায়গায় লাফ দিয়ে মারা গেছে সেখানে রক্তে ভেসে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমরা যতটুকু দেখেছি মুন্সিপাড়া বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাদে লাশের আশেপাশে রক্তের কোন ছিটেফোঁটা ছিলনা! এছাড়াও ওসি মইনুলের তিন জননী স্ত্রী মিনা’র পরকিয়ার বিষয় জানতো মৌসুমি, তাদের অপকর্ম ঢাকতেই হত্যা করা হতে পারে তাকে।

রংপুর মহানগরীর ১২নং ওয়ার্ড রাধাকৃষ্ণপুরের বাসিন্দা মো: মোজার পুত্র সাব ঠিকাদার জাহাঙ্গীর জানান, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২৩ ইং রাত আনুমানিক ১২টার পরে আবার এলাকাবাসী ভাতিজা সিরাজুল ইসলাম ওরফে সুরুজ পিওন আমাকে অনুরোধ করে বলেন চাচা, আপনার বাড়িতে একটু বসবো। পরে আমার ঘড়ে বসেন, স্থানীয় সোহান, সিরাজ, আজিজুল সাতাও, আবুল কালাম, মঞ্জুরুল ও তার পরিবার এবং উপস্থিত ছিলেন কুড়িগ্রামের ওসি মইনুল। ওসি সাহেব আমার সামনে বলেছেন ঘটনার দিন রাতে তিনি যখন বাসায় আসেন তখন মৌসুমিকে ঘড়ে দেখেছেন। তিনি আরও বলেন আপনাদের কারো কোন দাবীদাওয়া থাকলে আমাকে বলবেন। আমি চেষ্টা করবো আপনাদের দাবী পুরনের জন্য।

উল্লেখ: গত ১৩ ফেব্রুয়ারী ২৩ ইং সকালে স্থানীয়রা রংপুর মহানগরীর মুন্সিপাড়া বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাথরুমের ছাদে তরুণীর মরদেহ দেখতে পেয়ে, জরুরী সেবা ৯৯৯ এ কল দেন। পরে পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশের বাড়ি নামে পরিচিত “প্রয়াস এপার্টমেন্ট” এর কারো সাথেই এলাকাবাসীর তেমন কোন সম্পর্ক নেই।

স্থানীয়দের সাথে তেমন মিশেন না এই বাড়ির মানুষ। তবে প্রায়ই রাতে এই বিলাশবহুল ফ্ল্যাট থেকে কান্নাকাটি ও চিৎকার চেচামেচি শোনা যেত। পাঠশালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহনাজ বেগম জানান, সকাল আনুমানিক সাড়ে ৮টার দিকে স্কুলের আয়া সুমাইয়া স্কুলে গিয়ে বাথরুমের উপরে মরদেহের পা দেখতে পান। পরে স্কুল সংলগ্ন সহকারী শিক্ষিকা ফেরদৌসির বাসায় গিয়ে বলেন। ফেরদৌসী খবর পেয়ে আমাকে জানালে আমি দ্রুত স্কুলে যাই, তখন সময় আনুমানিক সকাল ৯টা আমি গিয়ে শুনি পুলিশ এসে তড়িঘড়ি করে লাশ নিয়ে গেছেন।

ঘটনার দিন সরেজমিন পরিদর্শন করেন, আবু বক্কর সিদ্দিক উপ পুলিশ কমিশনার (সিটিএসবি) আরপিএমপি, রংপুর। মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মাহফুজার রহমান, পিবিআই ইন্সপেক্টর রায়হান।এছাড়াও রংপুর মেট্রোপলিটন, জেলা পুলিশসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্তিত ছিলেন। এমনকি মৌসুমিকে মাটি দেবার সময়েও উপস্থিত ছিলেন পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা।

এলাকাবাসী প্রতক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ তরুণির লাশ উদ্ধারের সময় আমরা দেখেছি তার দুই পায়ের রগ কাটা ছিলো। আমাদের ধারণা হয়তো তাকে ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। স্থানীয়রা আরও জানান, তার মৃত নিশ্চিত করতেই পায়ের রগ কাটা হতে পারে। এলাকাবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এধরণের ন্যাক্কারজনক ঘটনার সঠিকভাবে তদন্ত হওয়া জরুরী।

আমরা এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই, অবিলম্বে দোষীদের গ্রেফতার করা নাহলে আমরা এলাকাবাসী মানববন্ধন সহ আন্দোলন কর্মসূচি পালন করবো। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে কর্মরত চিকিৎসক ডা: আয়শা পারভিন জানান, মৌসুমির পোষ্ট-মোর্টেম করা হয়েছে, ভিসেরা রিপোর্টের জন্য পাঠানো হয়েছে। এবং ধর্ষণ হয়েছে কি না তা নিশ্চিত করতে ভ্যাজাইনাল সোয়াব পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছেনা।

এবিষয়ে জানতে চাইলে, রংপুর মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ মাহফুজার রহমান জানান, ভাই আমি ওই সময় থানায় ছিলাম না তাই এব্যাপারে তেমন কিছু বলতে পারিনা। তবে ইউডি মামলা হয়েছে, মামলা নং-১৬ তারিখ ১৩/০২/২০২৩ইং , পোষ্ট মোর্টেম রিপোর্ট আসলে বিস্তারিত জানা যাবে। এখন পর্যন্ত কাউকে আইনের আওতায় আনা হয়নি। বিষয়টি স্যারেরা দেখছেন ওনারাই জিজ্ঞাসাবাদ করছেন আমি তেমন কিছু বলতে পারবো না।

মোশারফ হোসেন, রংপুর ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি
নিজস্ব প্রতিবেদক https://khoborbangla24.net

বিশ্বজুড়ে দেশের খবর

You May Also Like

More From Author

+ There are no comments

Add yours