দেশজুড়ে ডায়রিয়া আউটব্রেক; সুস্থ থাকতে করণীয়

Estimated read time 1 min read
Ad1

হঠাৎ করেই দেশজুড়ে ডায়রিয়া ভয়াবহ আকার ধারণ নতুন শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে!

প্রায় একমাস ধরেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বইছে তীব্র এবং অতি তীব্র তাপপ্রবাপ; বিভিন্ন জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২.৮ থেকে ৪৩ ডিগ্রি পর্যন্ত রেকর্ড হয়েছে! বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় অসহনীয় গরমে মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত; এরইমধ্যে গিয়েছে পবিত্র রমজান। রমজানে খাওয়া হয়েছে নানানপদের ভাজা-পোড়া খাবার আবার এক মাস রোজার পর ঈদজুড়েও চলেছে হাইপ্রোটিন ও রকমারি মশলাদার খাবার; ফলশ্রুতিতে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর চাপে হাসপাতালগুলোতে উপচে পড়া ভীড়! এমনকি ঈদের ছুটিতেও হাসপাতাল ওয়ার্ডগুলোতে ডায়রিয়া রোগীর চাপ ছিলো বেশ লক্ষ্যণীয়! এমনকি এখনও সেই প্রবাহ চলমান…

বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে ডায়রিয়া রোগের ভয়াবহতা নতুন কিছু নয়; কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ডায়রিয়া সংক্রমণ দেশজুড়ে শঙ্কার সৃষ্টি করেছে। সর্বশেষ তথ্যমতে, চট্টগ্রাম জেলার ১৫ উপজেলায় গেল ২৪ ঘণ্টায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ২৬৪ জন নারী-পুরুষ-শিশু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়েছে। একইসঙ্গে ২৪০ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। এর মধ্যে বোয়ালখালীতে ৫০ জন, চন্দনাইশে ৩৩ জন, পটিয়ায় ৩২ জন ও আনোয়ারায় ২৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন!

ডায়রিয়ায় প্রতি বছর পাঁচ বছরের কম বয়সের 500,000 শিশুর মৃত্যু হয়। সারা বিশ্বে এটি শিশু মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ। প্রতি দিন উদরাময় রোগে 2000 শিশুর মৃত্যু হয় যা ম্যালেরিয়া, হাম এবং এ-আই-ডি-এস রোগে মোট শিশু মৃত্যুর চেয়েও বেশি। তীব্র উদরাময় কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে। এই রোগের ফলে দেহের তরল পদার্থ নির্গত হয়ে জল-বিয়োজন (ডিহাইড্রেশন) ও লবণ (ইলেক্ট্রোলাইটস) নির্গত হয়, এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করলে, মৃত্যুও হতে পারে।

☞ ডায়রিয়া কি ও কেন হয় –

ডায়রিয়া কিংবা উদরাময় গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সংক্রমণের একটি উপসর্গ। এর কারণ বিশেষ কিছু ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস আর পরজীবী। এই রোগে দিনে তিন বা তার অধিক বার পাতলা মল নির্গত হয়।
ডায়রিয়া সংক্রমণে শক্তিশালী ভূমিকা রাখা ভাইরাসগুলোর মধ্যে রয়েছে নরোভাইরাস, অ্যাস্ট্রোভাইরাস, এন্টারিক অ্যাডেনোভাইরাস, ভাইরাল হেপাটাইটিস ও সাইটোমেগালোভাইরাস। রোটাভাইরাস বাচ্চাদের ডায়রিয়ার তীব্রতার জন্য দায়ী। কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসও ডায়রিয়া সংক্রান্ত জটিলতার সৃষ্টির পেছনে কাজ করে।
দূষিত পানি নরোভাইরাস, অ্যাস্ট্রোভাইরাস, হেপাটাইটিস এ ভাইরাস এবং স্যাপোভাইরাসের একটি বড় উৎস। হিমায়িত সবজি হেপাটাইটিস এ ভাইরাসের বড় উৎস। নোরোভাইরাস থাকে পাতাযুক্ত সবুজ শাকসবজি এবং তাজা ফলের মধ্যে।

দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে ই কোলাইয়ের মতো প্যাথজেনিক ব্যাকটেরিয়া বা পরজীবীর সংস্পর্শে আসার ফলে ডায়রিয়া হয়। দূষিত পানি ছাড়াও ই কোলাই কাঁচা বা কম রান্না করা গরুর মাংস, কাঁচা শাকসবজি এবং পাস্তুরিত দুধে থাকে।

☞ ডায়রিয়ার লক্ষ্মণ ও উপসর্গসমূহ –

পরিপাক নালীর অন্তর্নিহিত গোলযোগের উপসর্গ হল উদরাময় বা ডায়রিয়া রোগ।  অবশ্য, এর সাথে অন্যান্য লক্ষণও থাকতে পারে:
– পেটের পেশীর সংকোচন
– পেট ব্যথা
– পেট ফোলা
– তৃষ্ণা বৃদ্ধি পাওয়া
– ওজন হ্রাস হওয়া
– জ্বর
– বমি বমি ভাব
– হঠাৎ মলের বেগ আসা

✪ পাতলা মলের সাথে যদি নীচের উপসর্গগুলি হয়, তাহলে দ্রুত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া উচিত –

– ডায়রিয়া দুই দিনের বেশি সময় ধরে চলতে থাকে
– ক্রমাগত বমি
– অতি জল-বিয়োজনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে
– পেটে বা মলদ্বারে গুরুতর ব্যথা
– মল কালো রঙের বা রক্তাক্ত
– জ্বর হয়েছে, দেহের তাপমাত্রা 102 ডিগ্রি ফারেনহাইটের চেয়ে বেশি।
– খুব অল্পবয়সী বাচ্চাদের পাতলা মল হতে থাকলে খুব দ্রুত তাদের জল-বিয়োজনের হতে পারে। অতএব, যদি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অবস্থার উন্নতি না হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ।

☞ ডায়রিয়ায় করণীয়

সাধারণ অবস্থায় ডায়রিয়া কয়েক দিনের মধ্যে চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হয়ে যেতে পারে। দুর্বলতা কাটাতে পরিপূর্ণ বিশ্রামের পাশাপাশি হাইড্রেশন ও ইলেক্ট্রোলাইটস ব্যালেন্স ঠিক রাখার জন্য পর্যাপ্ত পানীয় পান করতে হয় এবং অন্যান্য খাবারের সময় সতর্ক থাকতে হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে আদর্শ পথ্য হলো ওরাল স্যালাইন; যতোবারই মলের সাথে জল – বিয়োগ ততবারই ওরস্যালাইন পান করুন। নির্দিষ্ট র‍্যাশিওতে ও.আর.এস তৈরীতে প্রায় অনেকেই ভুল করেন, এমনকি অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষজনও! বরাবর আধা লিটার (৫০০ মি.লি.) পানিতে এক স্যাচেজ ওরস্যালাইন গুলবেন এবং মেশানোর ১২ ঘন্টার মধ্যেই তা পান করবেন। বাজারের ও.আর.এস না থাকলে বাসায় বানিয়ে ফেলুন স্যালাইন – ১ লিটার পানীয় জলে (ফুটিয়ে নিয়ে ঠাণ্ডা করা) ৬ চা চামচ চিনি ও ১/২ চা চামচ লবণ মেশান। ২ বছরের কম বয়সের বাচ্চারা প্রত্যেকবার মলত্যাগের পরে ১/৪ থেকে ১/২ কাপ ও-আর-এস পান করবে। ২ বছরের অধিক বয়সের বাচ্চারা প্রত্যেক বার মলত্যাগের পর ১/২ থেকে এক কাপ ও.আর.এস পান করবে।

শরীরকে পানিপূর্ণ রাখার জন্য পরিষ্কার তরল পানি ও ফলের রস খেতে হবে। এ সময় দিনে প্রায় ২-৩ লিটার পানি পান করা প্রয়োজন
এছাড়াও দেহকে পানিপূর্ণ রাখতে সোডিয়াম, পটাসিয়াম এবং ক্লোরাইডের মতো স্পোর্টস পানীয়গুলো পান করা যেতে পারে। ঘনঘন বমি বমি ভাব হলে ধীরে ধীরে তরলে চুমুক দিয়ে পান করা ভালো।

উপসর্গ ২ দিনের বেশি থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন; চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ও নির্দিষ্ট ডোজ পূরণ না করে এন্টিবায়োটিক সেবন করবেন না। পরজীবী এবং ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে এমন বিভিন্ন ধরণের এন্টিবায়োটিক ওষুধ দেওয়া হয়। যে রোগগুলি ডায়রিয়ার কারণ, যেমন ক্রোন’স রোগ, আলসারেটিভ কোলাইটিস এবং ইরিটেবেল বাওয়েল সিনড্রোম, তাদের চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট ওষুধ দেওয়া হয়।

☞ জীবনধারা ব্যবস্থাপনা –

যে খাবারগুলো ডায়রিয়া বা শরীরে গ্যাসের অবস্থা আরও খারাপ করে এমন খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। এগুলোর মধ্যে আছে চর্বিযুক্ত বা ভাজা খাবার, কাঁচা ফল এবং শাকসবজি, মসলাদার খাবার, মটরশুঁটি ও বাঁধাকপি এবং ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়, যেমন: কফি ও সোডা।

যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিকিৎসা ছাড়াই শরীর উন্নতির দিকে যায় এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডায়রিয়া ভালো হয়ে যায়।

জীবনধারার কিছু পরিবর্তন করলে ডায়রিয়ার উপসর্গসমূহ তাড়াতাড়ি নিরাময় হয় এবং ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। এইগুলো হলো:

☞ সংক্রমণের সম্ভাবনা হ্রাস করে:

– শৌচ করার পর, রান্না করার আগে এবং পরে, ডায়াপার পরিবর্তনের পর কিংবা যেকোন কাজের পর সাবান/ হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলোন।
– স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার করুন
– শুধু মাত্র ফোটানো বা বোতল-জাত পরিশুদ্ধ পানি পান করুন।
– গরম পানীয় পান করুন।
– শিশু এবং বাচ্চাদের তাদের বয়সের উপযুক্ত খাদ্য দিন।
– ৬ মাস পর্যন্ত শুধুই মায়ের বুকের দুধ পান করান।
– সঠিক ভাবে খাদ্য মজুত করুন এবং খাবারের দেখভাল করুন।

☞ যা এডিয়ে চলবেন:

– নল, ওয়াসা কিংবা যত্রতত্র খোলা স্থানের জল পান করা।
– পানীয়, রস এবং বরফ তৈরির জন্য নলের পানি ব্যবহার করা।
– প্যাস্তুরাইজ না করা দুধ পান।
– রাস্তার পাশে অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া।
– কাঁচা এবং রান্না না করা খাবার এবং মাংস খাওয়া
– মদ্যপান করা
– মশলাযুক্ত খাবার খাওয়া
– ক্যাফিনযুক্ত পানীয় পান করা।
– ডায়েট কোলা পানীয়, মিছরি এবং চুইং গাম।

☞ সম্পূরকসমূহ :
এইচ-আই-ভি সংক্রমিত ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সের বাচ্চাদের ডায়রিয়া হলে ভিটামিন-এ সম্পূরক দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। বাচ্চাদের ডায়রিয়া প্রতিরোধে ভিটামিন এ, জিংক এবং অন্যান্য ভিটামিন দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

☞ রোটাভাইরাস ভ্যাক্সিনেশন-
বাচ্চাদের ডায়রিয়া প্রতিরোধ করতে রোটাভাইরাস’এর টিকা একাধিক ডোজে বাচ্চাদের খেতে দেওয়া হয়। এই টিকাগুলি রোটাভাইরাসে আক্রান্ত শিশুদের হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা হ্রাস করেছে।

এস. এম. ইকরাম হোসাইন
লেখক, গবেষক স্বাস্থ্য পরামর্শক

ল্যাব কনসালটেন্ট, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ

নিজস্ব প্রতিবেদক https://khoborbangla24.net

বিশ্বজুড়ে দেশের খবর

You May Also Like

More From Author

+ There are no comments

Add yours