ইউনুস আলী,কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ
৭ জানুয়ারি ফেলানী হত্যার দশ বছর। ঘাতকের গুলিতে প্রাণপ্রিয় সন্তানের নিষ্প্রাণ দেহ কাঁটাতারে ঝুলে থাকার দৃশ্য এখনও তাড়া করে বেড়ায় ফেলানীর বাবা-মাকে। তবে সন্তানের গুলিবিদ্ধ রক্তে রাঙানো নিথর দেহ কাঁটাতারে ঝুলে থাকার দৃশ্যের বেদনা আরও শতগুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে এক দশক ধরে ঝুলে থাকা বিচার প্রক্রিয়া। এরপরও নিরাশ নন সীমান্ত কন্যার বাবা মা। ন্যায় বিচার পাবার আশায় তারা তাকিয়ে আছেন ভারতের উচ্চ আদালতের দিকে। তাদের প্রত্যাশা, ভারতের সুপ্রিম কোর্টে ফেলানীকে হত্যাকারী বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের শাস্তি মিলবে- তারা মেয়ে হত্যার ন্যায় বিচার পাবেন। ফেলানী হত্যার দশম বার্ষিকীতে এমনটাই জানিয়েছেন তার বাবা নুর ইসলাম ও মা জাহানারা বেগম।
সন্তান হারানোর এক দশক কেটে গেছে, তবে প্রাণ প্রিয় সন্তানের গুলিবিদ্ধ দেহ কাঁটাতারে ঝুলে থাকার সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনও তাড়িয়ে বেড়ায় ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম ও মা জাহানারা বেগমকে। সীমান্ত আইনের যাতাকলে সন্তান হত্যাকান্ডের বিচার না পেয়ে তারা আরও বেদনা কাতর হয়ে পড়েছেন। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্স আদালতের বিচারে বাহিনীর অভিযুক্ত সদস্য অমিয় ঘোষকে দুইবার খালাস দেওয়া হয়, তবে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের কাছে এখনও ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করছেন ফেলানীর বাবা-মা। ফেলানীর দশম মৃত্যুবার্ষিকীতে মেয়ে হত্যার বিচার নিয়ে এমনই প্রত্যাশার কথা জানান তারা।
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি হালকা কুয়াশা ঘেরা সকালে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে বাবা নুর ইসলামের সঙ্গে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে ভারত থেকে দেশে ফিরছিল ফেলানী। তার বাবা আগে সীমান্ত অতিক্রম করলেও পেছনে থাকা ফেলানীকে লক্ষ্য করে বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ গুলি করেন, ঘটনাস্থলেই মারা যায় কিশোরী ফেলানী। ১৪ বছর বয়সী মেয়েটির মরদেহ কাঁটাতারে ঝুলে ছিল প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। এরপর দুই দিন দফায় দফায় পতাকা বৈঠকের পর বিএসএফ মরদেহটি বিজিবির কাছে ফেরত দেয়। পরে তাকে দাফন করা হয় নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের কলোনীটারী গ্রামের পৈতৃক ভিটায়।
ভারত সরকার ফেলানীর হত্যাকান্ডটি গতানুগতিক এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে দ্রুত বিচারে চাপ দেওয়া হয়। পরে ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট ভারতে ১৮১ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের সদর দফতরে স্থাপিত জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্স আদালতে ফেলানী হত্যার বিচার শুরু হয়। ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্যকে নির্দোষ ঘোষণা করে রায় দেয় নিজ বাহিনীর আদালত। ফেলানীর বাবা-মা রায় প্রত্যাখ্যান করলে ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুনর্বিচার কার্যক্রম শুরু করে ভারত। পরের বছর ২ জুলাই অভিযুক্তকে আবারও নির্দোষ ঘোষণা করে রায় দেওয়া হয়।
জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্স আদালতের পুনর্বিচারের রায় প্রত্যাখ্যান করে ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম ও কলকাতার মানবাধিকার সংগঠন ‘বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চে’র সাধারণ সম্পাদক কিরিটি রায় যৌথভাবে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে রিট আবেদন করলে ২০১৫ সালে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ শুনানি শেষে রিট আবেদনটি গ্রহণ করে বিবাদীদের জবাব দেওয়ার নোটিশ জারির আদেশ দেন। পরবর্তীতে বিবাদীরা তাদের জবাব দাখিলও করেছেন। কিন্তু এরপর তারিখের পর তারিখ পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু শুনানি এখনও হয়নি। এর আগে ২০১৩ সালের ২৭ আগস্ট ফেলানীর বাবা ও বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী একটি রিট আবেদন করেন ভারতের উচ্চ আদালতে। আজ অবধি সেটিরও কোনও শুনানি হয়নি ।
বাংলাদেশ সরকারের কাছে ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম ও মা জাহানারা বেগম অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘সরকার যেন রাষ্ট্রীয় যোগাযোগের মাধ্যমে ফেলানী হত্যার ন্যায়বিচারে সহায়তা করে। আমরা বেঁচে থাকতেই যেন বিচার পাই। নাহলে ওপারে গিয়ে ( মৃত্যুর পর) মেয়েকে কী জবাব দেবো!’
তাদের প্রত্যাশা, বিএসএফের জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্স আদালতের বিচারে নিজ বাহিনীর সদস্য ঘাতক অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দেওয়া হলেও ভারতের উচ্চ আদালতে তারা ন্যায় বিচার পাবেন।
বৃহস্পতিবার (৭ জানুয়ারি) দুপুরে নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের কলোনীটারী গ্রামে নিজ বাড়িতে ফেলানীর রূহের মাগফেরাত কামনায় মিলাদ মাহফিল ও দোয়ার আয়োজন করেছে তার পরিবার। এলাকায় মুদি দোকান চালিয়ে সংসার চালান ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ দশ বছরেও ফেলানীর স্মৃতি এতটুকু মুছে যায়নি। তার রূহের মাগফেরাতে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছি। তবে ফেলানীর আত্মা শান্তি পাবে যখন ঘাতক অমিয় ঘোষের শাস্তি মিলবে। আমার বিশ্বাস ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আমাদের মেয়ে হত্যার সুবিচার করে ঘাতককে শাস্তি দেবে, এই আশা নিয়েই বেঁচে আছি।’
মেয়ে হত্যার ন্যায় বিচারে সহায়তার পাশাপাশি কষ্টের সংসারে সহায়তা চেয়ে ফেলানীর মা জাহানারা বেগম বলেন, ‘ একটা ছোট মুদির দোকানের আয় দিয়ে সংসার খরচসহ ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া খরচ চালাতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। সরকার যদি ফেলানীর ছোট ভাই বোনদের কারও চাকরির ব্যবস্থা করে দিতো তাহলে আমরা কিছুটা স্বস্তি পেতাম।
+ There are no comments
Add yours