গত মাসে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতকে ‘গণতন্ত্রের জননী’ বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু ভারতের প্রতিবেশী বাংলাদেশের বর্তমান গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে তেমন কোনো মন্তব্যই করেননি। তার ওপর এই গল্পের বড় ট্র্যাজেডি হলো ভারতের সবচেয়ে বড় আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ।
২০১৪ সালে দেশটির বৃহৎ বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি করানোর জন্য চেষ্টা চালায় ভারত। তখন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিল বিএনপি। আওয়ামী লীগ বিএনপির দাবি মানতে রাজি না হওয়ায় দলটি নির্বাচন বয়কটের হুমকিও দিয়েছিল।
বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি ভারতের সমর্থনের অন্তর্নিহিত কারণ নিরাপত্তা এবং কৌশলগত উদ্বেগ। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো সংকীর্ণ শিলিগুড়ি করিডোরের মাধ্যমে দেশের অবশিষ্ট অংশের সঙ্গে যুক্ত, যা কিনা ল্যান্ডলকড। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সমুদ্রের মাধ্যমে ওই অঞ্চলটিতে প্রবেশের সুযোগ দিতে পারে। উত্তর-পূর্ব অঞ্চল কয়েক দশক ধরেই বিদ্রোহে বিপর্যস্ত।
আওয়ামী লীগ সরকার এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতাদের ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে এবং ওই দলগুলো যাতে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করতে কাজ করেছে। জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যময়, রাজনৈতিকভাবে অস্থির এবং বিদ্রোহপ্রবণ উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে শান্ত রাখতে ভারতের জন্য তাই বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক স্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্ব ১৯৭১ সাল থেকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে ভারত সক্রিয়ভাবে সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে সহায়তা করেছিল। আ. লীগের সঙ্গে ভারতের এই সম্পর্ক আবেগেরও বটে।
এদিকে বাংলাদেশে চীনের প্রভাব দ্রুতই বাড়ছে। ২০১৫ সালে চীন বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে ভারতকে ছাড়িয়ে যায়, যে অবস্থান ভারত চার দশক ধরে উপভোগ করে আসছিল। আট বছর পেরিয়ে গেছে বাংলাদেশ এখনও ভারতের চেয়ে চীন থেকে বেশি পণ্য আমদানি করে থাকে। শুধু চীনা পণ্যই নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিও চীনা অর্থের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে চীনের মোট ঋণের পরিমাণ ১৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, যা মূলত মেগা প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ করা হয়েছে৷ সামনে ঋণ পরিশোধের চাপ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস দেশটির অর্থনৈতিক সংকটের কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ পরিস্থিতি থেকে নিজেকে বের করে আনতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড় করা হলেও দ্বিতীয় কিস্তি নির্ধারিত সময়ে পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। আইএমএফ কর্তৃক নির্ধারিত ছয়টি শর্তের মধ্যে দুটি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আইএমএফ-এর ঋণ পেতে সফল না হলে বৈদেশিক রিজার্ভের ক্ষয়ের ধাক্কা কীভাবে সামলাবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
তাছাড়া চীনা ঋণ পরিশোধের সমস্যাও রয়েছে। আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের বিপরীতে চীন ঋণ পরিশোধে স্বল্প সময় প্রদান করে। তাদের সুদের হারও বেশি। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার, যা কিনা আগের বছরের তুলনায় ৩৭ শতাংশ বেশি। এই অর্থবছরে তা সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে।
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলোতে প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। চলমান অস্থিতিশীলতায় যুক্তরাষ্ট্রও চিন্তিত। বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। সম্প্রতি ওয়াশিংটন বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে যেখানে বলা হয়েছে, ‘কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তিকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা হলে তার ওপর ভিসানীতি প্রয়োগ করা হবে।’
এই পদক্ষেপ বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক পথে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে বলে অনেকে মনে করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের তথাকথিত অলিগার্কদের পশ্চিমে আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলবে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হতে পারে। বাংলাদেশে ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা, বহুত্ববাদ সহনশীলতা, সুশাসন এবং মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক নীতির সফল বাস্তবায়নে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের চর্চা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত মহাসাগরে চীনের কৌশলগত অগ্রগতির জন্য বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ চীন সাগরে নৌ অবরোধের ক্ষেত্রে চীনের সমুদ্রে প্রবেশে বাংলাদেশ বা মিয়ানমার অথবা উভয়েরই প্রয়োজন হবে। তাই চীন বাংলাদেশে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র দেখতে চায় না।
বাংলাদেশে চীনকে আটকে রাখার একটাই পথ খোলা রয়েছে; আর তা হলো, বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে শক্তভাবে পথ চলতে দেয়া।
+ There are no comments
Add yours