দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সমঝোতার মাধ্যমে ছাড় পাওয়া ২৬ আসনের মধ্যে ১২টিতেই তীব্র চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা।
আওয়ামী লীগদলীয় প্রার্থীদের প্রত্যাহার করা হলেও এসব আসনে জোরেশোরে ভোটের লড়াইয়ে নেমেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এর মধ্যে ‘লাঙ্গল’ প্রতীকের প্রার্থী দুর্বল হওয়ায় ৬টি আসন জাপার হাতছাড়া হওয়া প্রায় নিশ্চিত বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বর্তমান সংসদে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য আছেন ২৩ জন। তাদের মধ্যে চারজন দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের সঙ্গে রয়েছেন।
রওশন ও তার ছেলে সাদ এরশাদ এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হননি। আর দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা এবং রুস্তম আলী ফরাজী।
মসিউর রহমান রাঙ্গা রংপুর-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী। এই আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়েছে আওয়ামী লীগ। এখানে দলের মনোনয়নে লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করছেন এরশাদের ভাতিজা হোসেন মকবুল শাহরিয়ার।
তবে এই আসনে মসিউর রহমান রাঙ্গার জনপ্রিয়তা রয়েছে। তিনি গত দুটি নির্বাচনে এখান থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী গঙ্গাচড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আসাদুজ্জামান বাবুল।
এই আসনে স্বতন্ত্র তিনজনসহ মোট প্রার্থী ৯ জন। সব মিলিয়ে জাপার প্রার্থীকে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হতে পারে। এমনকি রাঙ্গার কারণে এ আসনটি জাপার হাতছাড়াও হতে পারে।
রুস্তম আলী ফরাজীর পিরোজপুর-৩ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মাশরেকুল আজম। রুস্তম আলী ফরাজী এই এলাকা থেকে বারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
দলীয় মনোনয়ন ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও তার জয়ের রেকর্ড আছে। এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আশরাফুর রহমান।
দলীয় সিদ্ধান্তে তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন আশরাফের বড় ভাই ব্যবসায়ী শামীম শাহনেওয়াজ। জাপার দুই নেতার সঙ্গে তার লড়াই ইতোমধ্যেই জমতে শুরু করেছে। এই আসনে লাঙ্গলের প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ বলে জানা গেছে।
গাইবান্ধা-২ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. আব্দুর রশীদ সরকারের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাঠে থাকছেন উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে ভোটে নামা আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহ সারোয়ার কবীর।
জাতীয় পার্টি সহজে ছাড় পাবে না বলেই মনে করছেন অনেকে। এখানে মোট প্রার্থী ৫ জনের মধ্যে স্বতন্ত্র দুজন। এখানেও ত্রিমুখী লড়াইয়ের মধ্যে পড়তে হবে জাপাকে।
সাতক্ষীরা-২ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. আশরাফুজ্জামানের জন্য লড়াই কঠিন করে তুলেছেন এই আসনের আওয়ামী লীগের দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থী। তারা হলেন আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ ববি এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এনছান বাহার বুলবুল। সব মিলিয়ে এই আসনে প্রার্থী সংখ্যা ৭। রয়েছে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থীও। এই আসনটি জাপার হাতছাড়া হাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সংরক্ষিত সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরীর সঙ্গে লড়তে হবে হবিগঞ্জ-১ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোহাম্মদ আব্দুল মুনিম চৌধুরীকে। এখানে মোট প্রার্থী সংখ্যা ৫।
ফেনী-৩ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন সাবেক সংসদ সদস্য রহিম উল্লাহ। তৃণমূল বিএনপির আছেন আজিম উদ্দিন আহমেদ।
সব মিলিয়ে প্রার্থী সংখ্যা ৮। এই আসনে সাবেক জাপা নেতা রিন্টু আনোয়ারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ভোটাররা বলছেন, এখানেও ভোটের লড়াই হবে জমজমাট।
এবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসন পেয়েছেন জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া। আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রত্যাহার করলেও স্বস্তি পাওয়ার সুযোগ নেই রেজাউলের। এখানে শক্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সহসভাপতি মো. মঈন উদ্দিন।
ঢাকা-১৮ আসনটি শেষ মুহূর্তে জাপার ভাগে পড়ে এবং দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদের প্রার্থী হয়েছেন। এই আসনে তিনিসহ প্রার্থী ১০ জন। আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য হাবিব হাসান সরে গেলেও স্বস্তি মিলছে না শেরিফার। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক মো. খসরু চৌধুরী স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
ফলে প্রথমবার ভোট করে শেরিফা কাদের লাঙ্গল নিয়ে কতটা নৌকার ভোট টানতে পারবেন, সেটাই বড় প্রশ্ন। এর বাইরেও শক্তিশালী প্রার্থী আছেন এই আসনে। সবার ধারণা, এখানেও জাপাকে লড়াইয়ের মুখে পড়তে হবে।
রংপুর-৩ আসনে মোট প্রার্থীর সংখ্যা ৬। এর মধ্যে জাপার পক্ষে আছেন দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নেই। অন্য দলগুলোর প্রার্থীরা খুব বেশি শক্তিশালী না হওয়ায় এই আসনটি জাপা পাচ্ছে, তা অনেকটাই নিশ্চিত বলা যায়।
নীলফামারী-৩ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী রানা মোহাম্মদ সোহেলের বিপরীতে আটজন প্রার্থীর মধ্যে ছয়জন শক্তিশালী প্রার্থী। এর মধ্যে ছয়জন স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচন করছেন। জাপার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী ফারুক কাদেরও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তৃণমূল বিএনপি ও জাপার স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকায় এই আসনে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি।
প্রায় একই ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হচ্ছে নীলফামারী-৪ আসনে জাপার বর্তমান সংসদ সদস্য আহসান আদেলুর রহমানকে। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোখছেদুল মোমিন। তিনি সৈয়দপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে প্রার্থী হয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রার্থীর সংখ্যা ৭। শক্তিশালী অবস্থানে আছেন তৃণমূল বিএনপির প্রার্থীও।
ময়মনসিংহ-৫ আসনে মোট প্রার্থী সংখ্যা ৫। এখানে জাপার প্রার্থী সালাহ উদ্দিন আহমেদ মুক্তি। আওয়ামী লীগের কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী নেই। অংশ নেওয়া অন্য দলগুলোর হেভিওয়েট প্রার্থী না থাকায় এখানে জাপার প্রার্থীর বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
ময়মনসিংহ-৮ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ফখরুল ইমামকে লড়তে হবে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া মাহমুদ হাসানের বিরুদ্ধে। মাহমুদ উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকও। এখানে পাঁচজন প্রার্থীর মধ্যে তিনজনই স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন। জাপার প্রার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হলেও আসনটি অনেকটাই লাঙ্গলের জন্য নিশ্চিত বলছেন স্থানীয় ভোটাররা।
নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে জাপার বর্তমান সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম ওসমান আবারও মনোনয়ন পেয়েছেন। এখানে মোট প্রার্থী চারজন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নেই। তাই এবারও এই আসনটিতে জাপার প্রার্থীর বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
বর্তমান সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারীর গাইবান্ধা-১ আসন। এখানে আওয়ামী লীগের কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১০ জন। এই আসনটিতে জাপার প্রার্থীর বিজয় অনেকটাই নিশ্চিত বলা যায়।
মানিকগঞ্জ-১ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী জহিরুল আলম রুবেলের প্রতিদ্বন্দ্বী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক স্বতন্ত্র প্রার্থী সালাউদ্দিন মাহমুদ। ফলে এখানেও জাপা প্রার্থীকে লড়াইয়ের মুখে পড়তে হবে।
কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে জাপার প্রার্থী দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। এই আসনে মোট প্রার্থী সংখ্যা ৭। চারজনই স্বতন্ত্র। তবে শক্তিশালী প্রার্থী না থাকায় এই আসনটি জাপার ঘরে আসতে পারে।
চট্টগ্রাম-৫ আসনে জাপার প্রার্থী বর্তমান এমপি ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের আসনে প্রার্থী সংখ্যা ৭। এখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী না থাকলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া শাহজাহান চৌধুরীর সঙ্গে জাপার লড়াই হবে।
চট্টগ্রাম-৮ আসনে জাপার প্রার্থী সুলেমান আলম শেঠ। মোট প্রার্থী ১০ জন। এখানে জাপার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম।
যিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন। জাপার প্রার্থীর জনপ্রিয়তা কম থাকায় এই আসনটি যেতে পারে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীর ঘরে।
কুড়িগ্রাম-১ আসনে জাপার এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমানসহ মোট প্রার্থী পাঁচজন। এখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী যেমন নেই, তেমনি অন্য দলের প্রার্থীদের মধ্যে শক্তিশালী প্রার্থী মাঠে নেই। এ কারণে এই আসনটি জাপার পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কুড়িগ্রাম-২ আসনে জাপার পনির উদ্দিন আহমেদসহ মোট প্রার্থী পাঁচজন। তাদের মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. হামিদুল হক খন্দকার। তিনি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী। তার সঙ্গেই জাপার লড়াই হবে। এই আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী নাজমুল হুদা সুমনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
বগুড়া-২ আসনে জাপার শরিফুল ইসলাম জিন্নাহসহ মোট প্রার্থী সংখ্যা ৭। তাদের মধ্যে স্বতন্ত্র আছেন তিনজন। এই আসনটিতে জাপার বিজয় অনেকটাই নিশ্চিত বলা যায়।
বগুড়া-৩ আসনে জাপার নূরুল ইসলাম তালুকদারসহ মোট ১১ জন প্রার্থীর মধ্যে পাঁচজন স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচন করছেন। এখানে প্রার্থী বেশি হলেও জাপা অনেকটাই নিরাপদ।
পটুয়াখালী-১ আসনে জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারসহ মোট প্রার্থী ছয়জন। এই আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নেই। তাই জাপার প্রার্থীকে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হবে না।
বরিশাল-৩ আসনে জাপার গোলাম কিবরিয়া টিপুসহ মোট প্রার্থী ছয়জন। এর মধ্যে স্বতন্ত্র আছেন দুজন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী না থাকায় জাপার প্রার্থীই শক্তিশালী।
ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে জাপার হাফিজ উদ্দিন আহমেদসহ নির্বাচনী লড়াইয়ের মাঠে আছেন চারজন প্রার্থী। এখানে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকায় আসনটি শেষ পর্যন্ত জাপার পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
সূত্র: কালবেলা
+ There are no comments
Add yours