পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত দেশের শীর্ষস্থানীয় নতুন প্রজন্মের বীমা কোম্পানি সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রাশেদ বিন আমানের দ্বন্দ্বে কোম্পানির পলিসিহোল্ডার ও শেয়ারহোল্ডারদের সর্বনাশ ঘটেছে।
এই দুজনের বিরুদ্ধে কোম্পানির অর্থ লুটপাটের অভিযোগ বিভিন্ন মহলে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি একপক্ষ অন্যপক্ষের বিরুদ্ধে মামলাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে। ছড়ানো হচ্ছে মিথ্যা নথিপত্রও। সর্বশেষ কোম্পানির চেয়ারম্যানের পদত্যাগের কারণে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ। পাশাপাশি কোম্পানিটির চলমান অস্থিরতার কারণে বোর্ড কেন ভেঙে দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।
জানা গেছে, সোনালী লাইফের সাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ৩১৫ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে সরকারি একটি সংস্থা। অন্যদিকে কোম্পানি সংশ্লিষ্টদের অভিযোগের ভিত্তিতে ৯ কোটি টাকা আত্মসাতের কারণে সিইও রাশেদ বিন আমানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এতে তার সহযোগী হিসেবে আরও ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে।
আইডিআরএর তথ্য বলছে, সোনালী লাইফের চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাপক অনিয়মে দুর্বল হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এক্ষেত্রে কোম্পানির এফডিআর ও সঞ্চয়ী হিসাবের বিপরীতে অর্থ তুলে চেয়ারম্যানসহ চার পরিচালকের শেয়ার ক্রয়ের মূল্য পরিশোধ, বোর্ডে পারিবারিক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চেয়ারম্যানের পরিবারের চার সদস্যের মধ্যে বিপুলসংখ্যক শেয়ার বিনামূল্যে হস্তান্তর, ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঋণের কিস্তি কোম্পানির হিসাব থেকে পরিশোধ, নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমতি ছাড়াই নিজের ফ্ল্যাট কোম্পানির কাছে বিক্রিসহ অন্তত ১৪ অভিযোগে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে আইডিআরএ। এমনকি কোম্পানির আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়োগ দেওয়া নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজেও হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে সাবেক এই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে।
এদিকে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রাশেদ বিন আমানের বিরুদ্ধেও অর্থ আত্মসাৎ ও হিসাব জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। এরই মধ্যে ৯ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় রামপুরা থানায় মামলা হয়েছে। মামলা সূত্রে জানা গেছে, সোনালী লাইফের ৯ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় সিইও রাশেদসহ সাতজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তারা হলেন সোনালী লাইফের সিইও মীর রাশেদ বিন আমান, সাবেক এইআর অফিসার ফাতেমা তামান্না সুইটি, হিসাব বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা সুমি শেন, সাবেক হেড অব পারচেজ রাজেশ আইস, সাবেক হেড অব ফাইন্যান্স মো. বোরহান উদ্দিন মজুমদার, হিসাব বিভাগের সাবেক ম্যানেজার মো. শিপন ভূঁইয়া ও সাবেক হেড অব ইনভেস্টমেন্ট সুজন তালুকদার।
আইডিআরএর যত অভিযোগ: কোম্পানির এফডিআরের বিপরীতে সাউথ বাংলা ব্যাংকে এসওডি হিসাব নং (০০০২৬২২০০০০৭৩) খুলে ঋণ গ্রহণ এবং ঋণ হিসাব থেকে ৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ও একই ব্যাংকে কোম্পানির সঞ্চয়ী হিসাব (০০০২১৩০০০০৩৩৪) থেকে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকাসহ ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা উত্তোলন করে চেয়ারম্যানসহ চারজন পরিচালকের শেয়ার ক্রয়ের মূল্য পরিশোধ করা হয়।
২০২২ সালে কোম্পানির বোর্ডে পারিবারিক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসসহ চার সদস্যের নামে বিপুলসংখ্যক শেয়ার বিনামূল্যে হস্তান্তর করেন। ২০২৩ সালে ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ড্রাগন সোয়েটারের ঋণের কিস্তি হিসেবে মাসে ৩ কোটি টাকা কোম্পানির হিসাব থেকে জনতা ব্যাংকে পরিশোধ করেন মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস।
কোম্পানির জন্য ভবন ক্রয়ের নামে কোম্পানির এফডিআরের বিপরীতে সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংক থেকে ১৫২ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ এবং এজন্য তিন বছরে প্রায় ১৫ কোটি টাকা সুদ প্রদান করা হয়, যার অনুমোদন নেওয়া হয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে।
মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের প্রভাব খাটিয়ে তার মালিকানাধীন ইম্পেরিয়াল ভবন কোম্পানি ৩৫০ কোটি টাকায় কিনতে সোনালী লাইফের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। আইডিআরএর অনুমতি ছাড়াই ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ভবনের মূল্য বাবদ ৫৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা অবৈধভাবে সোনালী লাইফ থেকে দেওয়া হয়। একই সময়ে কোম্পানির তহবিল থেকে ৬১ কোটি ৬২ লাখ ১০ হাজার ৫০০ টাকা উত্তোলন করে চেয়ারম্যানের মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাবে পাঠানো হয়। এ ছাড়া কোম্পানির পরিচালকরা অবৈধভাবে মাসে বেতনভাতা হিসেবে ৩ কোটি ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা নেন।
আইডিআরএর সার্কুলার অমান্য করে কোম্পানির চেয়ারম্যানের জন্য ১ কোটি ৭০ লাখ কোটি টাকায় বিলাসবহুল গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৭-৩৬৯৫০) ক্রয় ও ২০২১-২৩ মেয়াদে রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ বিপুল টাকা ব্যয় করা হয়। একই সময়ে চেয়ারম্যান ও তার পরিবারের সদস্য পরিচালকরা কোম্পানির ঘোষিত লভ্যাংশের অতিরিক্ত লভ্যাংশ নেন। এ ছাড়া কোম্পানির চেয়ারম্যানের বিদেশে চিকিৎসার যাবতীয় খরচ, নিজের ও পরিবারের সদস্যদের ভ্রমণ, শপিং খরচ, বিদেশে পড়ালেখার খরচ অবৈধভাবে কোম্পানির তহবিল থেকে নির্বাহ করা হয়।
কোম্পানির পরিচালক শেখ মোহাম্মদ ড্যানিয়েলের (চেয়ারম্যানের মেয়ের জামাই) ব্যক্তিগত অফিস কোম্পানির ভেতরে থাকা, গ্রুপ বীমা পলিসি থেকে বড় অঙ্কের কমিশন গ্রহণ এবং ঋণখেলাপি হওয়ার কারণে ২০২০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে পরিচালক না হয়েও বোর্ড সভায় অংশগ্রহণ, সম্মানী-বোনাসসহ বিভিন্ন অবৈধ সুবিধা গ্রহণ এবং ব্যাংক হিসাবের সিগনেটরি ছিলেন, যা আইন অনুযায়ী অবৈধ।
তথ্য বলছে, সরকারি একটি সংস্থার তদন্তে এসব অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসী চৌধুরী অ্যান্ড কোংকে গত ৩১ ডিসেম্বর নিয়োগ দেয়। পরে তদন্তে সহযোগিতা করতে কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
আইডিআরএ বলছে, কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান গত ৩ জানুয়ারি মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা অফিসে না থাকাসহ অন্যান্য কারণে তদন্তে ২০ দিন বিলম্ব করার আবেদন করেন। অন্যদিকে কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা একটি আবেদনে জানান, বোর্ডের চেয়ারম্যান ও অন্যরা তাকে অফিসে প্রবেশে বাধা দিচ্ছেন এবং তার অফিস তালাবদ্ধ করা রাখা হয়েছে। পরে তদন্ত কাজে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতার ক্ষেত্রে কোনো বাধা প্রদান না করার নির্দেশনা দিয়ে বোর্ড চেয়ারম্যানকে পত্র দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। কিন্তু কোম্পানির বোর্ডের হস্তক্ষেপ অব্যাহত থাকে এবং বোর্ড সভা করে তদন্ত কমিটি গঠন, কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা এবং কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে।
+ There are no comments
Add yours