পাঠ্যবইয়ে ভুল হওয়া পরিণত হয়েছে স্বাভাবিক বিষয়ে। বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এবারও পাঠ্যবইয়ে শতাধিক ভুল পেয়েছেন তারা। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে যোগ হয়েছে বিভিন্ন সাইট বা ব্লগ থেকে কপি করার প্রবণতা।
এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) মার্চ মাসে ভুল যাচাই করে সংশোধন দেওয়ার কথা জানিয়েছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, বইয়ে ভুলের বিষয়ে লেখক ও সম্পাদককে দায় নিতে হবে। পাশাপাশি বই লেখা ও সম্পাদনায় আরও সতর্ক থাকতে হবে।
গত বছর থেকে দেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের বই যায়। চলতি বছর গেছে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। এসব বইয়ের মধ্যে বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরের বইয়ে ভুলের পরিমাণ বেশি।
যেসব ভুল পাওয়া গেছে: বানানের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির বাংলা বানান রীতি অনুসরণের কথা বলা হলেও অনেক বানানেই সেই নীতি অনুসরণ করা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই ণত্ববিধান ও ষত্ববিধানের নিয়ম মানা হয়নি। মাধ্যমিক স্তরের বাংলা বইয়ে লেখক ও কবি পরিচিতি দেওয়া হয়েছে একেবারে সংক্ষিপ্ত আকারে। এ ছাড়া মলাটে এক শ্রেণি এবং ভেতরে অন্য শ্রেণির বই লেখা হয়েছে বলেও অভিযোগ এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নবম শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ বইয়ের দশম পৃষ্ঠায় নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র ও তার ব্যাখ্যায় গাড়ির ত্বরণের মান ভুল দেওয়া হয়েছে। একইভাবে ২১ নম্বর পৃষ্ঠায় তরলের ভেতরে চাপের ধারণা দিতে গিয়ে পারদের জন্য চাপের মান ভুল দেওয়া হয়েছে। ৩২ পৃষ্ঠায় অনুর গতি ও তাপমাত্রা অংশে সেলসিয়াস, কেলভিন ও ফারেনহাইটের মধ্যে তাপমাত্রার যে সম্পর্ক দেখানো হয়েছে, তা ভুল। ৩৬ নম্বর পৃষ্ঠায় কঠিন পদার্থের প্রসারণ অংশে ক্ষেত্রফলের পরিবর্তন হিসেবে যে মান দেখানো হয়েছে, তা-ও ভুল। ৪১ নম্বর পৃষ্ঠায় ক্যালরিমিতি অংশে কাচের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করার যে প্রয়োজনীয় তাপ দেখানো হয়েছে, সেটিও ভুল।
এই শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের দ্বিতীয় পৃষ্ঠার প্রথম লাইনে হাট লেখা হলেও তৃতীয় লাইনে (ঁ) যোগ করে হাঁট লেখা হয়েছে। ২৩ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে এ দেশটির স্বাধীনতার পেছনে রয়েছে লক্ষ্য মানুষের আত্মদান। এখানে লক্ষ্য এর জায়গায় হবে লক্ষ বা লাখো। ২৮ নম্বর পৃষ্ঠার প্রথম অনুচ্ছেদে লড়াইয়ের না লিখে লেখা হয়েছে লড়ায়ের। ৩৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ভাষণগুলোতে না লিখে লেখা হয়েছে ভাষণগুলোর।
একই পৃষ্ঠায় লক্ষ্যকে লক্ষ লেখা হয়েছে। ৩৬ নম্বর পৃষ্ঠায় র্যাডক্লিফকে লেখা হয়েছে র্যাডাক্লিফ। ৩৮ নম্বর পৃষ্ঠায় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের গঠনকাল লেখা হয়েছে ১৯৬০ সাল। মূলত এটির গঠন নিয়ে দুটি সালের তথ্য পাওয়া যায়। এগুলো হলো ১৯৬১ ও ১৯৬২ সাল। ৪৪ নম্বর পৃষ্ঠায় স্বাধীনতা লাভের পর যে সময়কালের ঘটনা বর্ণনা হয়েছে, সেখানে বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী/রাষ্ট্রপতি হিসেবে লেখা হয়েছে। তিনি কী ছিলেন, তা নির্দিষ্ট করা হয়নি।
৫৪ নম্বর পৃষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণকে লেখা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ্য। একই পৃষ্ঠায় সাম্রাজ্যের-কে সাম্রাজ্যর এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রান্জ ফার্দিনান্দকে লেখা হয়েছে যুবরাজ ফারডিনাগু। ৫৯ নম্বর পৃষ্ঠায় সংবাদ সম্মেলনকে লেখা হয়েছে সাংবাদ সম্মেলন। ৫৮-৬০ পৃষ্ঠায় বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ অনুচ্ছেদের সঙ্গে বাংলা উইকিপিডিয়ার ‘বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ’ অংশের হুবহু মিল পাওয়া গেছে। ১০০তম পৃষ্ঠায় সবার ওপর মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই—এটি মধ্যযুগের কবির লেখা উল্লেখ করা হলেও সেই কবি বড়ু চণ্ডীদাসের নাম উল্লেখ নেই।
এই শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি বইয়ের ভূমিকায় সহযোগিতাকে ‘সহযোগীতা’ লেখা হয়েছে। ‘পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়’—বাক্যটি ১৫ বার ব্যবহার করা হলেও ১৩ বারই ‘পৃখিবী’ লেখা হয়েছে। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিকের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানিক, পাকিস্তানকে লেখা হয়েছে পকিস্তান। ণত্ববিধান ও ষত্ববিধান না মেনে ‘ভাতখণ্ড’কে লেখা হয়েছে ‘ভাতখন্ড’। এই শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের ২৬ পৃষ্ঠায় বাংলা কবিতা থাকলেও ঠিক তার পরেই ইংরেজি কিছু নতুন শব্দের অবতারণা হয়েছে।
অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ২৩ পৃষ্ঠায় প্রকৌশলী ফজলুর রহমান খানের মৃত্যুসাল দুটি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমে জন্ম-মৃত্যু (১৯২৯-১৯৮২) লেখা হলেও পরবর্তী সময়ে ১৯৮৩ লেখা হয়েছে। তিনি মূলত ১৯৮২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। এই বইয়ের ২৬ নম্বর পৃষ্ঠায় শিক্ষার্থীদের ইউনিক আইডি নম্বর চাওয়া হয়েছে। যদিও এখনো শিক্ষার্থীরা ইউনিক আইডি কার্ড ও নম্বর পায়নি। ৪০তম পৃষ্ঠায় ষষ্ঠকে লেখা হয়েছে ‘ষষ্ট’।
৫৩ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ‘ত্রয়োদশ০০ সাল’। ৮২ নম্বর পৃষ্ঠায় কিলোমিটারকে লেখা হয়েছে ‘কীলোমিটার’। ১০৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ৩০ লাখ শিশু শ্রমিকের কথা বলা হয়েছে। যদিও গত বছরের জুলাই মাসের হালনাগাদ অনুযায়ী দেশে শিশু শ্রমিক ৩৫ লাখ। ১২১ নম্বর পৃষ্ঠায় চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বাম পাশে তার শিল্পকর্ম মোনালিসার অবস্থান লেখা হয়েছে, এটি হবে ডান পাশে। ১৩০ নম্বর পৃষ্ঠায় ঝুঁকিকে ‘ঝুঁকী’ লেখা হয়েছে। ১৫৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ঝুঁকিপূর্ণকে লেখা হয়েছে ‘ঝুঁকীপূর্ণ’।
একই শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে সুস্থ বানান লেখা হয়েছে ‘সুস্থ্য’। এ ছাড়া বাক্য গঠনেও অনেক ভুল ও অসংগতি ধরা পড়েছে। বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের ফিল্ড ট্রিপ অধ্যায়ে (৬৪ পৃষ্ঠা) খরগোশ ও কচ্ছপের গল্পের মধ্যে দৌড় প্রতিযোগিতার যে গাণিতিক সমাধান চাওয়া হয়েছে, সেটিকে ভুল বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মত হলো, এক ঘণ্টায় তিন কিলোমিটার প্রতিযোগিতার জন্য যে আদিবেগ ও ত্বরণের মান দেওয়া হয়েছে, তাতে খরগোশ ঘণ্টায় ১৩ কিলোমিটার যেতে পারবে। গত বছর ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান অনুশীলন পাঠ বইয়ের ‘চাঁদ সূর্যের পালা’ অধ্যায়ে অভিশপ্ত চাঁদ বাদ দিয়ে ‘চাঁদের গল্প’ নাম দেওয়ার সুপারিশ করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি। কিন্তু এ বছরও সেটি একই রাখা হয়েছে।
মাদ্রাসা স্তরের ষষ্ঠ, সপ্তম, নবম ও দশম শ্রেণির ‘কাওয়াইদুল লুগাতুল আরাবিয়্যাহ’ বইয়ের মলাটে এসব শ্রেণির আরবি নামের ক্ষেত্রে ব্যাকরণগত ভুল করা হয়েছে। যেমন সপ্তম শ্রেণির আরবি নামে লেখা হয়েছে ‘আসসাফফু’। শব্দের শেষ বর্ণে পেশ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী শব্দের শেষ বর্ণে ব্যবহার করা হয়েছে যের। আরবি ব্যাকরণের নিয়ম হলো, প্রথম শব্দের শেষ বর্ণে পেশ হলে পরের শব্দের শেষ বর্ণেও পেশ এবং প্রথম শব্দের শেষ বর্ণে যের হলে পরের শব্দের শেষ বর্ণেও যের দিতে হবে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান বলেন, এটি মারাত্মক ভুল। এতে আরবি ব্যাকরণ যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি।
এদিকে অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১০৪ নম্বর পৃষ্ঠায় নারীরা এখন বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী ও শ্রমমন্ত্রী বলা হয়েছে। বইটি গত বছর যখন লেখা হয়েছে, তখনকার সময়ের জন্য ভুল না হলেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মন্ত্রিসভায় রদবদলের কারণে তথ্যটি এখন আর সঠিক নয়। দীপু মনির জায়গায় এখন শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন মুহিবুল হাসান চৌধুরী আর গত মেয়াদে বেগম মন্নুজান সুফিয়ান শ্রম প্রতিমন্ত্রী থাকলেও এবার মন্ত্রণালয়টির দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী নিয়েছেন। স্কুলগুলোতে এ তথ্য সংশোধনী আকারে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম।
নবম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ের ‘মিলেমিশে নিরাপদে বসবাস’ নামক অধ্যায়ের ১৪৯ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘নগর বসতি’ শিরোনামের পাঠে একটি মানচিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে লেবানন, সিরিয়া, সামারা, জেরিকা, জুড়িয়া, ইসরায়েল, জেরুজালেম, গাম্বিয়া, মিশর, জর্ডান নামক স্থানের অবস্থান দেখানো হয়েছে। বইটিতে দাবি করা হচ্ছে, এ মানচিত্রটি প্রাচীন জেরিকো নগরের অবস্থান নির্দেশ করছে।
এদিকে নতুন শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রণীত পাঠ্যবইয়ে থাকা ভুলভ্রান্তি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে এনসিটিবি। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মতামত যৌক্তিকভাবে বিশ্লেষণ করে দ্রুত তা সংশোধনের আশ্বাস জানানো হয়েছে এনসিটিবির পক্ষ থেকে।
+ There are no comments
Add yours