রাজধানীর ফার্মগেটের খামারবাড়িতে অবস্থিত কৃষি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস)। গণমাধ্যমের সাহায্যে কৃষি তথ্যপ্রযুক্তি তৃণমূল পর্যায়ের কৃষকের কাছে পৌঁছানোই এ সংস্থার মূল লক্ষ্য।
কিন্তু সেখানে কাজ হয় ভিন্ন। বিভিন্ন প্রকল্প, প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও অপকর্মের মাধ্যমে এ সংস্থার অর্থ লোপাটের অভিযোগ মিলেছে বড় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
শক্তিশালী সিন্ডিকেট ও এআইএসের গুটিকয়েক চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী সংস্থার টাকা আত্মসাৎ করেন। ডকুমেন্টারি-শিল্পী সম্মানীর নামেও অর্থ আড়ালে নেন তারা।
বহু দিনের অভিজ্ঞ কৃষি তথ্য সার্ভিসের (এআইএস) ইলেকট্রনিক মিডিয়া বাংলাদেশ বেতারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে কৃষি বিষয়ক কার্যক্রমে সার্বিক ‘সহায়তা দেয়’। জাতীয় ও মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনে বিষয়ভিত্তিক ডকুমেন্টারি, ড্রামা, টিভিসিও সম্প্রচার করে। এ পর্যন্ত শতাধিক স্পট, ফিলার, ফিল্মসহ বিভিন্ন কৃষি তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর ভিডিও তৈরি করেছে সংস্থাটি।
আঞ্চলিক কার্যালয়ের সিনেমা ভ্যানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা ও আধুনিক কৃষি তথ্য প্রযুক্তি প্রসারে সচেষ্ট করা হলো কৃষি তথ্য সার্ভিসের ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কাজ। কিন্তু জানা গেছে, সংস্থার পরিচালক ড. সুরজিত সাহা রায় এসব কর্ম পরিচালনায় অদক্ষ। নিজের অদক্ষতা লুকাতে ইলেকট্রনিক মিডিয়া শাখা থেকে অনেক মেধাবী কর্মকর্তাকে সুকৌশলে সরিয়ে দিয়েছেন তিনি। শাখার অন্যান্য কর্মকর্তারাই এ অভিযোগ করেছেন।
তবে গুরুত্বপূর্ণ সূত্রের অভিযোগ, কৃষি তথ্য সার্ভিসের ইলেকট্রনিক মিডিয়া খাত ও সফটওয়্যার, আইসিটির কেনাকাটায় পরিচালক সুরজিত সাহা রায়ের নেতৃত্বে টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট বাদল চন্দ্র সরকার, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর সঞ্জিত কুমার ভৌমিক ও ক্যাশিয়ার মো. জুয়েল হোসেন মিলে ভুয়া বিল, ভাউচার ও কোটেশনের শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের রয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতিসম্পন্ন ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া শাখা। সংস্থার দুই অভিজ্ঞ ভিডিও ক্যামেরাম্যান, সহকারী ক্যামেরাম্যান, ভিডিও এডিটর, লাইটিং অ্যাসিস্ট্যান্ট, উন্নত যন্ত্রাংশসমৃদ্ধ স্টুডিও থাকার পরও ডকুমেন্টারির নামে-বেনামে ভুয়া বিল ভাউচার করে নিচ্ছেন পরিচালক ও তার সিন্ডিকেট। এআইএসের জন্য একটি ড্রোন কেনা হয়েছে। কিন্তু বছর পার হলেও তা অফিসকে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে না।
সূত্র জানিয়েছে, পরিচালক ড. সুরজিত সাহা রায়ের নেতৃত্বে অবৈধ বিল-ভাউচার তৈরিতে সহায়তা করেন সঞ্জিত কুমার ভৌমিক ও জুয়েল হোসেন। ডকুমেন্টারি তৈরি ও কলাকুশলীদের সম্মানীসহ বিভিন্ন খাতে খরচ দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করেছেন তারা।
সরকারি সব সম্মানী ভাতায় ফোন নম্বর উল্লেখ থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু তাদের করা কোনো ভাউচারে কোনো শিল্পীর ফোন নম্বর দেওয়া নেই। তা ছাড়া শিল্পী সম্মানীর জাল স্বাক্ষরের মাধ্যমে ভাউচার দেখিয়ে টাকা তুলে নেন সুরজিত, সঞ্জিত ও জুয়েল।
২০২৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর কৃষি তথ্য সার্ভিসের স্বাক্ষরিত ১১৪/ক তারিখের একটি ভাউচার ঘেঁটে দেখা গেছে, অডিট থেকে বাঁচতে শিল্পীদের উপস্থিত থাকার জন্য একটি পত্র জারি করেছেন পরিচালক। তাতে শিল্পীদের নাম-ঠিকানা দেওয়া হয়েছে ঠিকই; কিন্তু কারও মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, কৃষি তথ্য সার্ভিসের সব বিল-ভাউচারের হিসাব সংক্রান্ত নথিপত্র সাজাতে পরামর্শ দেন সঞ্জিত ও জুয়েল। সেগুলো অনুমোদনও হয় পরিচালকের স্বাক্ষরে।
রপ্তানিযোগ্য আমের সংগ্রহত্তোর পরিচর্যা বিষয়ক ডকুমেন্টারি বিল। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসের ১ তারিখ ৬০ নম্বর বিল থেকে তোলা হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। একই তারিখে আমের পুষ্টিগুণ সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্টারির জন্য (৬১ নম্বর বিল) ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা; ব্রয়লার মুরগির জন্য নিরাপদ কার্যপ্রণালীর ডকুমেন্টারি (৬২ নম্বর বিল) থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। ৯৮ জাতের ব্রি-ধান চাষ শীর্ষক ডকুমেন্টারি জন্যও (টিবিসি বিল ১১৬) ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়।
একই বছর সেপ্টেম্বর মাসের ১৩ তারিখ সারের পরিমিত ব্যবহার সংক্রান্ত ডকুমেন্টারির জন্য (১১৭ নম্বর বিল) ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা; পলিনেট হাউজে সবজি চাষের ভিডিওর জন্য (বিল-১২৩) ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা; ডকুমেন্টারি এডব্লিউডি সাশ্রয়ী পানি সেচ (বিল-১২৪) ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ও ব্রি-ধান ৮৭ ডকুমেন্টারির জন্য ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন পরিচালক ও তার সিন্ডিকেট সদস্যরা।
এ ছাড়া ২০২৩ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রি-ধান ৯০ ও ৩০ অক্টোবর ব্রি-ধান ৯৪ ডকুমেন্টারির জন্য দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা তোলা হয়েছে। একই বছর ৫ নভেম্বর ব্রি-ধান ৮৫; ৭ নভেম্বর ব্রিধান ৯৩ ও ব্রি-ধান ১১; চর এলাকার বাদাম চাষের ডকুমেন্টারির জন্য চার বিলে মোট পাঁচ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।
২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর চর এলাকার মিষ্টি কুমড়া চাষ; ভার্মি কম্পোস্ট; বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ; ফুল চাষে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা; সোলার ইরিগেশন; টাইকো কম্পোস্ট; স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরিষার তেল বিষয়ক টিভিসি ৭টি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সম্প্রচারের জন্য কয়েকটি বিল দেখিয়ে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন এআইএসের অবৈধ সিন্ডিকেট।
আবার ২০২৩ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩টি বিল দেখিয়ে মোট ২২ লাখ ৯৯ হাজার ৮৩২ টাকা তুলে নিয়েছেন পরিচালক ও তার চক্রের সদস্যরা। শুধু ডকুমেন্টারি নয়, সাতটি বেসরকারি টিভিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরিষার তেলবিষয়ক টিভিসি প্রচার বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ১৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা। এসব বিলে সংশ্লিষ্ট টেলিভিশনের বিল ভাউচার পাওয়া যায়নি।
২০২৩ সালের ৩১ জুলাই স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরিষার তৈল বিষয়ক টিভিসি ৭ বেসরকারি চ্যানেলে সম্প্রচার বাবদ ১৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। অন্যান্য ফল ও ফসলের ডকুমেন্টারির দুই ডজনের বেশি বিল করা হয়েছে। প্রতিটির বিল ধরা হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা করে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেখানকার একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রতিটি শ্যুটিংয়ের ক্ষেত্রেই এমন বিল তৈরি করা হয়।
একেক সময় একেক রকম বিল করেন বড়কর্তা। কিছু বিষয়ে শ্যুটিং করাই হয়নি। বিল তোলার আগে পুরোনো ভিডিও যোগ করে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের একটি উন্নতমানের ড্রোন আছে। অথচ কোনো ভিডিওতে ড্রোন থেকে ধারণকৃত দৃশ্য দেখা যাবে না।
শিল্পী সম্মানীর ভাউচার স্বাক্ষর নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আর্থিক সুবিধার জন্য ভুয়া বিল ভাউচার করেছে। জানা গেছে, ডকুমেন্টারির ২০টি বিল ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা করে ২৫ লাখ ও অন্যান্য আরও ১০ লাখ টাকাসহ মোট ৩৫ লাখ টাকা পরিচালক ড. সুরজিত সাহা রায়ের নেতৃত্বে সঞ্জিত কুমার ভৌমিক ও ক্যাশিয়ার মো. জুয়েল হোসেন আত্মসাৎ করেছেন।
এ ব্যাপারে কৃষি তথ্য সার্ভিসের এক কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্যাশিয়ার জুয়েল প্রতিটি বিল-ভাউচার থেকে ৫ শতাংশ উৎকোচ নেন। অডিটের কথা বলেও তিনি ৩ শতাংশ ঘুষ আদায় করেন। সিন্ডিকেটের ক্ষমতা বলে স্টক এন্ট্রি ছাড়াই তিনি বিল পাস করেন। কৃষি তথ্য সার্ভিসের আঞ্চলিক অফিসে বরাদ্দ দিয়েও মাসোহারা নেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ক্যাশিয়ার জুয়েলকে তার নির্ধারিত বেতন তুলতে হয় না। ঘুষ ও অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে তিনি অনেক সম্পদের মালিক হয়েছেন। নামে বেনামে তার অনেক সম্পত্তি রয়েছে। তার বিরুদ্ধে কথা বলা যায় না। কেউ কিছু বললেই তার ওপর জুয়েলের খড়্গ পড়ে।
সংস্থার টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট বাদল চন্দ্র সরকারকে আইসিটি ইনচার্জের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেন পরিচালক সুরজিত। দায়িত্ব পাওয়া পর তার আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়েছে বলে অভিযোগ অন্যদের।
জানা গেছে, সংস্থার টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট বাদল চন্দ্র সরকার আইসিটি ইনচার্জের অতিরিক্ত দায়িত্বও পালন করেন। টেকনিক্যাল বিষয়ে পড়াশোনা করা এই ব্যক্তি আইসিটি স্পেশালিস্ট হিসেবে কৃষি তথ্য সার্ভিসের সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট ডেভেলপ করার নামে লাখ লাখ টাকার ভুয়া বিল ও কোটেশন করে যাচ্ছেন।
নন-টেকনিক্যাল লোক হয়েও সামলান এআইএস ল্যাব, এআইএস কনফারেন্স। আইসিটি সংক্রান্ত সব ইকুইপমেন্ট কেনাকাটা ও মেরামত, কথিত উদ্ভাবনীর নামে লাখ লাখ ভুয়া বিল ভাউচারও হয়েছে তার হাত দিয়েই।
এছাড়া বাদল চন্দ্র সরকার ব্যয় প্রাক্কলন ও বাজার যাচাই কমিটির সদস্য হওয়ায় কৃষি তথ্য সার্ভিসে নামে বেনামে পছন্দেও সরবরাহকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দিয়েও অর্থ আত্মসাৎ করছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি কৃষি তথ্য সার্ভিস আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, খামারবাড়ি, ঢাকা প্রকল্পে ভিডিও ক্যামেরা ও সফটওয়্যার, আইসিটি মালামালে ক্রয়ের সঙ্গেও জড়িত।
২০২৩ সালের ৭ জুন ২ লাখ ৯৪ হাজার ৪৫০ টাকা ক্যামেরা বাবদ নেন তিনি। পরবর্তীতে একই বছর ২৯ নভেম্বর ২৫২১ নম্বর বিলে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৩০০ টাকা স্টোর ম্যানেজ আপডেট; ৩০ নভেম্বর উদ্ভাবন ইনোভেশন হিসেবে অনলাইন পিডিএস ওয়েবসাইট করতে ২৫০ নম্বর বিলে ২ লাখ ৯৪ হাজার টাকা বিল করেন। ২৬ ডিসেম্বর ৫৬২ নম্বর বিলে ক্যামেরা কিনতে দেখিয়েছেন ২ লাখ ৯৪ হাজার টাকা।
এসব বিষয়ে প্রশ্নসহ কৃষি তথ্য সার্ভিসে কোন কোন কমিটিতে তিনি সদস্য জানতে চাইলে বাদল চন্দ্র সরকার বলেন, আমি তিন সদস্য বিশিষ্ট বাজারদর মূল্যায়ন কমিটির সদস্য। এ সময় তার নামে কোনো অভিযোগ নেই বলেও জোর দাবি করেন তিনি।
ভুয়া-বিল ভাউচার বানিয়ে লাখ-লাখ টাকা উত্তোলনের বিষয় অস্বীকার করে বাদল বলেন, বিল-ভাউচারের সঙ্গে আমি জড়িত নই। অফিসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাদের এখানে মালপত্র কেনা হয়। সরকারি ডিপার্টমেন্টে নিয়ম ছাড়া কোনো কাজ করার সুযোগ নেই। আমি নিয়ম ছাড়া কোনো কাজ করি না।
ডকুমেন্টারি বিল ভাউচারে শিল্পী সম্মানীর টাকা নিজে পরিশোধ করেছেন, ভাউচারগুলোয় সব শিল্পী কলাকুশলীর এক হাতের লেখা- বিষয়ে প্রশ্ন করলে এআইএসের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক সঞ্জিত কুমার ভৌমিক বলেন, এ বিষয়ে আমাদের ফিল্ম প্রোডাকশন অফিসারের সঙ্গে কথা বললে জানতে পারবেন।
২৪টিরও বেশি ডকুমেন্টারির বিল একই এসেছে কেন- প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমি বলতে পারব না। ফিল্ম প্রোডাকশন অফিসার জানেন। প্রতিটি বিলে একই ব্যক্তির লেখা ও সেসবের মিল থাকা এবং সইয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে সুরজিত বলেন, ফিল্ম প্রোডাকশন অফিসার আছেন তারা এ বিষয়ে বলতে পারবেন। সব ধাপ পার হওয়ার পরে সর্বশেষে আমার কাছে আসে, তখন আমি স্বাক্ষর করি।
+ There are no comments
Add yours