কাঠগড়ায় কাঁদলেন মাজহারুল, আয়নাঘরে চাকরি করিনি বলেলন জিয়াউল

Estimated read time 1 min read
Ad1

 

ডেস্ক নিউজ:

গনহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে কাঠগড়ায় দাড়িয়ে হাউ মাউ করে কাঁদলেন রাজধানীর গুলশান থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাজহারুল ইসলাম।

 

অন্যদিকে, গুম-নির্যাতনের বন্দীশালা হিসেবে পরিচিত “আয়না ঘরে” চাকরি করেননি বলে ট্র‍্যাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বললেন এনটিএমসি’র সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউল আহসান।

বুধবার ট্র‍্যাইব্যুনালে হাজির করা সাবেক পুলিশ প্রধানসহ ৮ আসামিদের বিরুদ্ধে একে একে গনহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এ সময় ট্র‍্যাইব্যুনালে হাজির মাজহারুলকে সাভার এলাকার ওসি উল্লেখ করেন চিফ প্রসিকিউটর।

তখন কাঠগড়ায় দাড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাজহারুল বলেন, ‘আমি কখনো সাভার এলাকায় দায়িত্বে ছিলাম না। আন্দোলনের সময় গুলশান থানার দায়িত্বে ছিলাম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আমি ছাত্রদের পক্ষে ছিলাম। আমাকে বাঁচান, আমি বাঁচতে চাই।’

এ সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘আপনি যদি নির্দোষ হন, আপনি ন্যায়বিচার পাবেন।’

একপর্যায়ে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ভুল করে মাজহারুলকে সাভার এলাকায় দায়িত্বপালনের কথা তিনি বলেছেন। আন্দোলনের সময় মাজহারুল গুলশান থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাড্ডা এলাকায় মাজহারুলের নেতৃত্ব হত্যাকাণ্ডের নানা বর্ণনা তুলে ধরেন তিনি।

এদিকে, আজ আদেশের আগে কাঠগড়ায় দাড়িয়ে এনটিএমসি’র সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউল আহসান ট্রাইব্যুনালকে বলেন, আমি কখনো আয়নাঘরে চাকরি করিনি। আমি চাকরি করেছি যেখানে, সেটি একটি ট্যাকনিক্যাল জায়গা। বারবার আমার বিরুদ্ধে আয়নাঘরকে জড়িয়ে মিডিয়ায় অপপ্রচার করা হচ্ছে। আমি কখনোই আয়না ঘরে চাকরি করিনি। আমাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।

তখন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, আপনি একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। আপনার আইনজীবী এখানে আছেন। তারা আপনার পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরবেন। তাদের বক্তব্যে সন্তুষ্ট না হলে তখন আপনি বলার সুযোগ পাবেন।’

বুধবার সকালে এনটিএমসি’র সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিচালকসহ ৭ পুলিশ কর্মকর্তাকে ট্র‍্যাইব্যুনালে হাজির করা হয়। প্রথমে তাদের ট্র‍্যাইব্যুনালের হাজত খানায় রাখার পর তোলা হয় কাঠগড়ায়। একপর্যায়ে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম অভিযুক্তদের জুলাই আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সম্পৃক্ততার বিস্তারিত বর্ননা দেন।

এসময় সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিষয়ে শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, তাঁর নেতৃত্বে পুলিশের বিভিন্ন শাখা (র‌্যাব, কেপিবিএন, ডিবি, এসবি) দেশের গুম, হত্যা, আটক, নির্যাতন, লাশ পোড়ানোসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে ও গণহত্যা চালিয়েছে। তিনি ছিলেন এসব কর্মকাণ্ডের প্রধান। তাঁর নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সারা দশে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলে পুলিশের আচরণ ছিল বেপরোয়া। জুলাই-আগস্টের হত্যা-গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, নির্দেশনা, প্ররোচনাসহ দায় ওপর বর্তায়। তিনিই ছিলেন এসবের সুপ্রিম কমান্ডার।

এনটিএমসি’র সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানের সম্পর্কে শুনানিতে তাজুল ইসলাম বলেন, তিনি আওয়ামী লীগের মতাদর্শের বিরোধী ব্যক্তিদের গুম, খুন, অপহরণ, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত। তিনি এনটিএমসির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সরকার বিরোধীদের শায়েস্তা করতে নজরদারী করতেন। জুলাই-আগস্টের গণহত্যার সময় সারা দেশে মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধে জিয়াউল আহসানের ভূমিকা পেয়েছে তদন্ত সংস্থা। ইন্টারনেট বন্ধ করে ইনফরমেশন ব্লাক আউটের মাধ্যমে গণহত্যায় মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। আয়নাঘরের নেপথ্যের কারিগর ছিলেন জিয়াউল আহসানকে উল্লেখ করে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম, ইলয়াস হোসেন, যুবদল নেতা সাজেদুল হক সুমন, ইফতেখার দীনারসহ অসংখ বিরোধী মতাদর্শের ব্যক্তিকে গুমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এই জিয়াউল আহসান। তাঁর এই বেআইনি কর্মকাণ্ডের পরও তিনি তাঁর পদে বহাল তবিয়তে ছিলেন। তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচয় দেওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পেত না। তিনি পতিত সরকারের এতই ঘনিষ্ঠ ছিলেন যে, একের পর এক পদোন্নতি পেয়ে প্রভাশালী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। এছাড়া আয়না ঘর নামক যে বন্দিশালা তৈরি করা হয়েছিল তার সাথে জিয়াউল আহসান সম্পৃক্ত উল্লেখ করে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, কল রেকর্ড ফাঁস ও বিভিন্ন ব্যক্তির ফোনে আড়ি পাতায় জড়িত এই জিয়াউল আহসান।

এদিকে, মিরপুর জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. জসিম উদ্দিন মোল্লার বিষয়ে শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, জুলাই-আগস্ট গণআন্দোলনে মিরপুরের যত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, তার প্রধান নির্দশে দাতা ছিলেন এই ব্যক্তি।

ঢাকার সাবেক পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহ আল কাফির অপরাধ সম্পর্কে বলা হয়, সাভারের শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যার নির্দেশ সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা। তাজুল ইসলাম বলেন, আন্দোলন চলাকালে সাভারে পুলিশের এপিসি ভ্যানের ওপর থেকে ইয়ামিন নামের তরুণকে গুলি করে রাস্তায় ফেলে দেওয়ার ভিডিও ফুটেজ ইন্টারনেট মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ভিডিওতে দেখা গেছে, গুলির পরও ইয়ামিন জীবিত ছিল। কিন্তু তাঁকে হাসপাতালে না নিয়ে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে মৃত্যু ত্বরান্বিত করতে দেখা গেছে। এমনকি তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করতেও বাধা দেওয়া হয়। এছাড়া সাভারের আশুলিয়াতে ৬ জনকে গুলি করে হত্যার পর মরদেহ পুলিশ ভ্যানে উঠিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলনকারীদের ওপর দায় চাপানো। কিন্তু তদন্তে প্রকৃত ঘঠনা উঠে এসেছে।

আশুলিয়ায় ৬ জনের লাশ পোড়ানোর ঘটনার সাথে সাভার সার্কেলের সাবেক অতিরিক্ত সুপার মো. শহিদুল ইসলাম ও ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেনের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তদন্তে তা উঠে এসেছে বলে শুনানিতে ট্রাইব্যুনালকে জানান চিফ প্রসিকিউটর।

গুলশান থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাজহারুল হকের অপরাধ তুলে ধরে তাজুল ইসলাম বলেন, ঢাকা মহানগরের তেজগাঁ, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন এই ব্যক্তি। জুলাই-আগস্ট মাসে তিনি ছিলেন গুলশান থানার দায়িত্বে। এসময় গুলশান জোনে কাফি, বাহাদুর হোসেন মানিক, সোহাগ, ওয়াসিমসহ যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তার নির্দেশদাতা ছিলেন তিনি।

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান সম্পর্কে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, গণআন্দোলনের সময় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও ওয়ারীতে শত শত লোককে হত্যা করা হয়। শুরু থেকেই আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এই আবুল হাসান। স্বৈরাচারের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি হত্যা, জখম, নির্যাতন, গণহত্যায় তিনি ছিলেন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশদাতা। স্বৈরশাসকের আজ্ঞাবহ হয়ে তিনি অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে কয়েক হাজার ছাত্র-জনতাকে গুরুতর জখম করেছেন। তাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন, দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে তাঁদের স্বজনদেরই আসামি করে মামলা করেছেন। আহতদের চিকিৎসা নিতে বাধা দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপন্সসিবিলিটির প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত সংস্থা।

 

শুনানি শেষে একপর্যায়ে প্রসিকিউটশনের আবেদনের প্রেক্ষিতে জুলাই আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখিয়ে সাবেক পুলিশ প্রধান এবং এনটিএমসি’র সাবেক মহাপরিচালকসহ ৮ কর্মকর্তাকে কারাগারে রাখার নির্দেশ দেন বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সেই সাথে এদের ক্ষেত্রে তদন্তের জন্য একমাস সময় দিয়ে আগামী ১৯ ডিসেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেয়া হয়।

যে ৮ কর্মকর্তাকে কারাগারে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তারা হলেন: সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (এনটিএমসি)’র সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব:) জিয়াউল আহসান। ঢাকার সাবেক পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহ আল কাফি, ঢাকা মহানগর পুলিশের মিরপুর জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. জসিম উদ্দিন মোল্লা, সাভার সার্কেলের সাবেক অতিরিক্ত সুপার মো. শহিদুল ইসলাম, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান, গুলশান থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাজহারুল হক ও ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন।

ট্রাইব্যুনালে আজ চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম শুনানি করে। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম, বি এম সুলতান মাহমুদ ও আব্দুল্লাহ নোমান। অন্যদিকে আজ আসামিপক্ষে জিয়াউল আহসানের পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী এম আই ফারুকী ও নাজনীন নাহার। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জাইয়াদ বিন আমজাদ, মো. জসিম উদ্দিন মোল্লার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মাহবুবুর রহমান। আবুল হাসানের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আরাফাত হোসেন।

গত ৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের কয়েকশত অভিযোগ এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন অফিসে জমা পড়েছে। গত ১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়।

এদিকে, জুলাই-আগস্টের সংঘটিত নজিরবিহীন গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ৯ মন্ত্রী, দুই উপদেষ্টা, অবসরপ্রাপ্ত এক বিচারপতি ও সাবেক এক সচিবকে কারাগারে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

অন্যদিকে, গত ২৭ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুলিশের সাবেক ১৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ২০ অক্টোবর তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজিরের নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী আজ ৮ কর্মকর্তাকে হাজির করলে আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যাল।
সূত্র: চ্যানেল আই

খবর বাংলা ২৪

নির্বাহী সম্পাদক, খবর বাংলা ২৪ ডট নেট

You May Also Like

More From Author

+ There are no comments

Add yours