নিহার বিন্দু চাকমা | রাঙামাটি
মহামারী প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাওয়াই গত বছর ২৭মার্চ থেকে সারা বাংলাদেশ লগডাউন ঘোষণা করা হয়। এতে ১২-১৪এপ্রিল পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী প্রধান অন্যতম সামাজিক উৎসব বিঝু উদযাপন করা সম্ভব হয়নি। তারই ধারাবাহিকতায় একবছর পর উৎসবমুখর পরিবেশে আজ ১২এপ্রিল (২৯চৈত্র ১৪২৭বঙ্গাব্দ) ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে সীমিত পরিসরে তিনদিন ব্যাপী আনুষ্ঠানিকভাবে বিঝু উৎসব শুরু হয়েছে।
রাঙামাটি শহরের রাজবাড়ী ঘাট ফুল ভাসাতে আসা অমর কুমার চাকমা বলেন, ‘এটি পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের ঐহিত্যবাহী সামাজিক উৎসব। করোনা কারণে গত বছর উৎসবটি সেভাবে হয়নি। এবার নির্দেশনা মেনে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে বিশ্ব যেন করোনা মুক্তি পায় সেই প্রার্থনা করা হয় মা গঙ্গা দেবীর কাছে। আমরা যেন আগামী বছর সুন্দর করে আগের মতো উৎসবটি পালন করতে পারি।’
রাঙামাটি রাজবন বিহারের উত্তর ঘাট ফুল ভাসাতে আসা সীমা চাকমা বলেন, সকালে ফুল সংগ্রহ করে ঘর সাজিয়ে এখন নদীতে ফুল ভাসাতে এসেছি। ফুল ভাসনোর মধ্যে দিয়ে পুরনো বছরের দুঃখ বেদনাকে ভাসিয়ে দিলাম এবং নতুন বছর যেন আরও অনেক ভালোভাবে কেটে যায়। করোনা থেকে দ্রুত বিশ্ব মুক্ত হোক। আমরা সবাই চাই আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারি সেই কামনা করি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী সম্প্রদায়ের উৎসবটি ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ‘বৈসুক’ মারমা জনগোষ্ঠীর ‘সাংগ্রাই এবং চাকমা জনগোষ্ঠীর ‘বিঝু’ নামে পরিচিত।
এই তিনটি উৎসবের প্রথম অক্ষরগুলো নিয়ে সংক্ষেপে ‘বৈসাবি’ নামকরণ করা হয়েছে।
বাংলাবর্ষের চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিনকে ফুল বিঝু বলা হয়। দ্বিতীয় দিনকে বলা হয় ‘মূলবিঝু’। কেউ রাত ১২টার পরে কেউ ভোরে ফুল তুলে নদীতে ভাসাতে যায়। মূলত জীবনে পানি’র অবদানকে স্বীকার করার জন্য পানির প্রতি কৃতজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ এটি। এর পাশাপাশি পানির যত উৎস আছে সেখানেও ফুল দেওয়া হয়। কুয়া,ছড়া, ঝর্ণা,ঝিরি যা থাকে পানির উৎস। ঠিক একই ভাবে সূর্য ডোবার সাথে সাথে পানির উৎসে (ছড়া,নদী,কুয়া,ঝর্ণা,ঝিরি) এবং সবুজ বৃক্ষের নীচে মোমবাতি জ্বালানো হয় প্রকৃতিকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য। যে প্রকৃতি সারা বছর ফুল,ফল দেয় । এই দিনে পরিবারে এবং গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের স্নান করানো হয়। মূলত আগেকার দিনে পানির উৎস দূরে হওয়ায় তাঁরা নদীতে যেতে পারেন না বলেই এ আয়োজন। তবে এখনও এ ঐতিহ্যবাহী প্রথা রীতিনীতি চালু রয়েছে। এখন শহরাঞ্চলে ও রীতিনীতি প্রথা অনুসারে প্রায় পালন করে দেখা যায়। ফুল বিঝু’র দিনে ফুল দিয়ে ঘর সাজানোও একটা ঐতিহ্যর অংশ। সাথে থাকবে নিমপাতা। নিমপাতা শুদ্ধতার প্রতিক। প্রতিটি বাড়ীতে বুদ্ধকে ফুল দিয়ে পূজা করা হবে। ফুলবিজু’র দিনে ভোরে উঠে স্নান করার একটা রীতি আছে। বিশ্বাস যে আগে স্নান সারবে সে বিঝুগুলো পাবে। এটা মূলত শারীরিক শুদ্ধতাকে উদ্বুদ্ধ করে।পরিচ্ছন্নতাকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস। বর্তমানে করোনা সংক্রমণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে আবার ঢিলেঢালা লগডাউন তাই একবছর পর সীমিত পরিসরে বিঝু উদযাপন করা হলে ও শহরাঞ্চলে কারো মনে কোন আনন্দ-উল্লাস নেই।
বিঝু উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ইন্টু মনি তালুকদার বলেন, গত বছর করোনার কারণে কোনও আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। এবার ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হলেও হঠাৎ করোনা বৃদ্ধি পাওয়াই সব স্থগিত করা হয়েছে। যে যার মতো বাড়ির আশেপাশে হ্রদের জলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ফুল ভাসাবে।
এদিকে জেলা প্রশাসক জানান, স্বাস্থ্য বিধি মেনে একটা জায়গায় অবস্থান করতে হবে। অপ্রয়োজনে ঘুরাঘুরি করা যাবে না। তিন দিনব্যাপী নিজ নিজ ঘরে পরিবারের সাথে বিঝু উৎসব পালনের আহ্বান জানান।
+ There are no comments
Add yours