ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন
সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চবি, সাবেক মুফতি, চট্টগ্রাম নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসা
জিলহজ মাসের দশ, এগারো বা বারো তারিখ আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নির্ধারিত পশু জবাই করাকে কুরবানি বলা হয়। নিজের যৌক্তিক প্রয়োজন মেটানোর পর কারো নিকট যদি সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা অথবা সে পরিমান নগদ টাকা থাকে তাহলে তার ওপর একটি ছাগল বা ছাগল জাতীয় পশু কুরবানি দেয়া ওয়াজিব। গরু বা গরু জাতীয় পশু হলে প্রতি জনের পক্ষ থেকে অন্তত সাত ভাগের একভাগ দিতে হবে। কুরবানির জন্য উল্লেখিত পরিমাণ সম্পদ পূর্ণবছর স্থিতি থাকা আবশ্যক নয়; যা যাকাতের ক্ষেত্রে আবশ্যক। কুরবানির মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তায়ালার বড়ত্ব প্রকাশ এবং তাঁর প্রদত্ত নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা। প্রাপ্ত নেয়ামত স্বীকার, কৃপণতা বর্জন, দরিদ্রকে দান ও আপ্যায়নপূর্বক তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করাও কুরবানির উদ্দেশ্য। আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের এ প্রচেষ্টার অপর নাম তাকওয়া। যেমন বলা হয়েছে, “আমি প্রত্যেক জাতির জন্য কুরবানিকে ইবাদতের অংশ করেছি; যাতে জীবনোপকরণ হিসেবে যে গবাদি পশু তাদেরকে দেয়া হয়েছে, তা জবাই করার সময় তারা যেন আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে” (সুরা হজ: ৩৪)। আরো বলা হয়েছে, “পশুর রক্ত-মাংস আল্লাহর নিকট পৌঁছে না, তাঁর নিকট পৌঁছে তোমাদের নিষ্ঠাপূর্ণ আল্লাহভীতি” (প্রাগুক্ত: ৩৭)। প্রাসঙ্গিক আরেকটি আয়াতের অর্থ হলো, “আপনি বলুন, আমার নামায, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ শুধু আল্লাহর জন্য, যিনি সমগ্র জগতের পালনকর্তা (সুরা আল-আন্আম: ১৬২)।” পবিত্র হাদিসে বলা হয়েছে, “আদম সন্তানের জন্য কুরবানির দিন পশু জবাইয়ের চেয়ে আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় আর কোন ইবাদত নেই” (তিরমিযি)। উল্লেখিত আয়াত ও হাদিসের আলোকে কুরবানির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট। সুতরাং পশু ক্রয়ের টাকা, জবাই-পদ্ধতি, জবাইয়ের উদ্দেশ্যসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি যদি শরিয়ত সম্মত না হয় তাহলে কুরবানির মূল লক্ষ্য অর্জিত হবে না। অর্থাৎ নিয়তের পরিশুদ্ধি, বৈধ সম্পদের ব্যবহার এবং পশু হালালকরণ যথাযথ হতে হবে। লোক-দেখানো, সামাজিক রীতি মানা বা “পাছে লোকে কিছু বলে” ইত্যাদি মানসিকতা নিয়ে পশু জবাই করলে কুরবানি হবে না। অনুরূপভাবে কারো আমানত নষ্ট করে বা পাওনা রেখে দিয়ে কুরবানি করলেও তা কবুল হবে না। চুরি, ডাকাতি, আত্মসাৎ, দূর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ দিয়ে কুরবানি দেয়াও বৈধ নয়। এক্ষেত্রে লৌকিকতা, হীন প্রতিযোগিতা, বিত্ত-বৈভব জাহির করার মানসিকতা সম্পূর্ণরূপে পরিহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, অপরিশুদ্ধ নিয়ত, অবৈধ সম্পদ বা অননুমোদিত পন্থায় কৃত কুরবানি আল্লাহর তায়ালার নিকট অগ্রহণযোগ্য। গৃহীত হবে তাঁর কুরবানি, যিনি আল্লাহ প্রেম ও খোদাভীতি নিয়ে সুন্নাত তরিকায় কুরবানি করেন। যেমন বলা হয়েছে, “তিনি শুধু খোদাভীরুদের কুরবানি কবুল করেন” (সুরা মায়িদা: ২৭)। কুরবানির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করাও ঈমানি দায়িত্ব। পশুর বর্জ্য ও ময়লা-আবর্জনা যথাযথভাবে অপসারণ না করে কুরবানি করলে নিজের ও অন্যের কষ্টের কারণ হয়। তাই কুরবানির ক্ষেত্রে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নাতা ও বর্জ্য অপসারণের বাজেটও রাখতে হবে। ইসলামি শরিয়ার একটি নীতি হলো, যখন কোন বিধান আরোপিত হবে তখন তার আনুসাঙ্গিক বিষয়গুলোও বিধিত হয়ে যাবে। সুতরাং কুরবানির সক্ষমতার মাপকাঠি মধ্যে পশু ক্রয়, কসাই মজুরি, জবাই উত্তর ভালভাবে পরিস্কার করার ব্যয়ও অন্তভুর্ক্ত হবে। শুধু পশু ক্রয় বা জবাই করে মাংস ঘরে তুলার মধ্যে দায়িত্ব শেষ নয়। বিশেষত মহামারিকালীন আরো সতর্কতার সাথে কুরবানি করতে হবে।
পবিত্র হাদিসে পরিচ্ছন্নতাকে ঈমানের অর্ধেক বলা হয়েছে। অপবিত্রতা, অপরিচ্ছন্নতা ঈমানি চরিত্রের বিপরীত। মুমিন মাত্রই যেমন বিশ্বাসগত পরিচ্ছন্ন, তেমনি তাঁর বাহ্যিক অবস্থাও হবে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। মনের কলুষতা যেমন ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক, তেমন শারিরীক, পারিপার্শ্বিক অপরিচ্ছন্নতাও। তাই নামায, পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদিতে অযুকে আবশ্যক করা হয়েছে। অযুর অর্থ পানি ব্যবহার করে শরীরের সুনির্দিষ্ট অংশ পরিস্কার রাখা। দৈনিক অন্তত পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জন্য পাঁচ বার অযু করার মধ্য দিয়ে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য জীবাণু মুক্ত থাকা। অর্থাৎ শারীরিক সুস্থতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ইসলামি শরিয়ায়। সুস্থ থাকার এ পদ্ধতি খুবই যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক। যেসব কারণে জীবাণু ছড়ায় বা রোগ সংক্রমিত হয় সেগুলো থেকে দূরে থাকার নির্দেশনা আছে পবিত্র হাদিসে। সংক্রমণ রোধ করার উদ্দেশ্যে ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্তকে অন্যের সংস্পর্শে যাওয়ার এবং সুস্থ ব্যক্তিকে তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এসব কিছুর বিবেচনায় কুরবানিতে সাবধানতা অবলম্বন করা অত্যাবশ্যক। করোনাকালীন বিষয়টি আরো চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, কুরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মানুষের কষ্ট লাঘব করা তথা দরিদ্র মানুষের জন্য ভাল খাবারের ব্যবস্থা করা। যেমন এর মাংসের এক তৃতীয়াংশ নিজের আর বাকি অংশ আত্মীয় ও দরিদ্রের প্রাপ্য বলা হয়েছে, যদিও এ বিধানটি আপেক্ষিক। বলা হয়েছে, “তোমরা কুরবানির পশুর মাংস নিজে খাও আর হত-দরিদ্রকে খাওয়াও” (সূরা হজ: ২৮)। যদি কুরবানি করে বর্জ্য অপসারণ করা না হয় অথবা এ ক্ষেত্রে অবহেলা করা হয় তাহলে এর মাধ্যমে পরিবেশ দূষিত হয়। ফলে রোগ-জীবাণু সৃষ্টি হয়। এতে কষ্ট পায় কুরবানিদাতা নিজে এবং আশপাশের মানুষ। তখন আল্লাহ তায়ালার হক আদায় হয় সত্য, কিন্তু নষ্ট হয় বান্দার হক। সর্বোপরি দূষিত হয় পরিবেশ। অথচ পরিবেশ সুরক্ষাও ঈামানি দায়িত্ব। যেমন পবিত্র হাদিসে জলাধার, রাস্তাঘাট ও বৃক্ষের ছায়ায় মলমূত্র ত্যাগ করাকে অভিশাপ প্রাপ্তির কারণ বলা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে, “তোমরা তোমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দূষণ মুক্ত রাখো”। বদ্ধ পানিতে মূত্র ত্যাগ করতেও নিষেধ করা হয়েছে। হাদিসের ভাষ্য মতে, ঈমানের সত্তরের বেশি শাখার মধ্যে সর্বনিম্ন শাখা হলো মানুষের চলাচলের পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্ত অপসারণ করা। কুরবানির পশুর রক্ত, নাড়িভুঁড়ি ও বর্জ্য যত্রতত্র ফেলে রাখা মানে পথিককে কষ্ট দেয়া। তাই কুরবানি দেয়া ও বর্জ্য অপসারণ, দুটোই ঈমানি দায়িত্ব। অবশ্য, সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষকেও এ ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে।
+ There are no comments
Add yours