আকাশ মারমা মংসিং | বান্দরবানঃ
পার্বত্য এলাকায় আদিবাসীদের ঐতিহ্য বাড়ি নাম টঙঘর। এটি পার্বত্য এলাকায় মাচাং ঘর নামে পরিচিত। পার্বত্য জেলা বান্দরবানে উঁচু নিচু ও পাহাড়ের সমতল স্থান সহ আঁকাবাঁকা পাহাড়ি সড়কে এক সময় বাড়তি নজর কেড়ে নিত এই মাচাং ঘর।
এর বাহারি বাঁশের নকশা নিয়ে একে অপরে সঙ্গে প্রতিযোগিতাও কমতি ছিল না। যে যতটুকু পারে বাঁশের বানানো দিয়ে চলত বাড়ি সৌন্দর্য নিয়ে টক্কর। তবে কালের বিবর্তন ও আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়ায় পাহাড় থেকে শতকরা ৯৫ শতাংশ টঙ ঘর হারিয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে টিনের ঘর আর বড় বড় পাকা দালান। তবে ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখনো অনেকে টঙ ঘর টিকিয়ে রেখেছেন অনেকে।
বান্দরবানে সদর উপজেলা, রুমা, থানছি, লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, রোয়াংছড়িসহ সাতটি উপজেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনেক পরিবারই তাদের বসবাসের জন্য মাচাং ঘর তৈরি করেন। বিশেষ করে দূর্গম এলাকায় জুম চাষাবাদ এবং বসবাসের জন্য মাচাং ঘরগুলো তৈরি হয়। সাধারণত বাঁশ, ছন দিয়ে নিপুণভাবে তৈরি হয় এসব মাচাং ঘর। তবে ঘরের বেশির ভাগ অংশেই বাঁশের ব্যবহার হয়ে থাকে। ছনের মাচাংগুলো দেখতে যেমন চৌকস, তেমনি প্রাকৃতিক শীতাতপ হওয়ার কারণে এই মাচাং ঘরে বসতে ও ঘুমাতে খুবই আরামদায়ক।
মিনঝিড়ি পাড়ার বাসিন্দা অংহ্লাচিং মারমা (৫৫) বলেন, ‘সব ঋতুতে টঙ ঘর আরামদায়ক। এসব ঘরে শীতকালে গরম ও গরমকালে ঠান্ডা অনুভূত হয়। তাই টঙ ঘরকে প্রাকৃতিক এসি ঘরও বলা যেতে পারে।’তবে জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং পাহাড় থেকে বাঁশ ও ছন হারিয়ে যাওয়ার ফলে বর্তমানে বান্দরবানের বিভিন্ন স্থানে বাঁশের, ছনের তৈরি মাচাং ঘরের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। জুম পাহাড়ের শীর্ষে কিংবা ছোট বাগান বাড়িতে একসময় জমির মালিকরা মাচাং ঘর তৈরি করে সেখানে তাদের সময় ব্যয় করতেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে চাহিদার মতো বাঁশ, গাছ ও ছন না পাওয়ায় এখন পার্বত্য জেলাগুলো মাচাং ঘর হারিয়ে যাওয়ার পথে।
আদিকাল থেকে পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো বন্য পশু ও জীবজন্তুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মাচাং ঘরে বসবাস করত। মাচাংগুলো সাধারণত মাটি থেকে ৫-৬ ফুট উঁচু করে তৈরি হতো। আর মাচাং তৈরির একমাত্র উপকরণ ছিল পাহাড়ি ছন ও বাঁশ। তাই একসময় তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ব্যাপক ছনের কদর ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তন ও জুম চাষের কারণে ছনের উৎপাদন কমে যাবার কারনে হুমকিতে পড়েছে পাহাড়ি ছনের ঘর। আদিবাসীদের ঐতিহ্য মাচাং ঘরটি সম্পূর্ণ বাঁশ, গাছ আর ছন দিয়েই তৈরি হতো মাচাং ঘর। ঘরের মূল খুঁটিগুলো হয় গাছ দিয়ে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বড় বড় বাঁশের খুঁটি দিয়েও তৈরি হয়ে থাকে। মাচাংয়ের সাথে খুঁটির যে সন্ধি বা সংযোগ রয়েছে, সেগুলো বাঁধাই করা হতো বাঁশের বেত দিয়ে। অল্প বয়সী কঁচি বাঁশ হতে তৈরি করা হয় এই বেত। বাড়ির মাচাংকে ধরে রাখতে মাচাংয়ের সমান্তরাল বাঁশের সাথে খুঁটির প্রত্যেকটি সন্ধিতে মাটি থেকে দেওয়া হতো ঠেঁস। কাঠ, বাঁশ আর ছন দিয়ে তৈরি মাচাং ঘরের তেমন দেখা মেলে না। বাঁশ, বেত আর খুঁটির দাম বেশি হওয়ায় মাচাং ঘরের প্রতি তেমন আগ্রহ নেই আদিবাসীদের। যার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী এই ঘর ।
কুহালং সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান বাসিমং মারমা বলেন (৫৫) মারমা বলেন, আমাদের গ্রাম সহ পাশ্ববর্তি গ্রাম অনেক আছে সেইখানে ধীরে ধীরে দালান কোটা ঘর উঠছে। দিন দিন যেভাবে উন্নয়ন দিকে এগোচ্ছে সেই সাথে আমাদের মাচাং ঘর হাড়িয়ে যাচ্ছে। ‘টঙ ঘরকে মারমা ভাষায় ডাকে তবে বাংলায় অনেকে মাচাং ঘর হিসেবে জানে। টঙ আমাদের পাহাড়ের ঐতিহ্য। নিজেদের ঐতিহ্য রক্ষার্থে টঙ ঘরকে বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে টিকিয়ে রাখা দরকার।’ এর জন্য দরকার নিজেদের ভিতরে একটি আত্ববোধ যা ঐতিহ্যকে রাখতে মানসিক কাজ করবে।
রুমা পান্তলা পাড়া বাসিন্দা শৈহাইমং মারমা (৪৫) বলেন, রুমাতে পর্যন্ত বাঁশ ও ছন খুজে পাওয়া খুবই কষ্টের ব্যাপার। আগের মত যেখান সেখান থেকে খুজে পেতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। তবে অনেকে ছন পরিবর্তে উপরে টিন দিয়ে মাচাং ঘর বানাচ্ছে অনেক। এতে স্বস্তি না পেলেও যে যার সামর্থ্যনুযায়ী বানাচ্ছে। তিনি আরো বলেন ‘টিন এক বান কিনতে অনেক টাকা লাগে। কিন্তু কোনো খরচ ছাড়াই প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা গাছ, বাঁশ দিয়ে তৈরি করা যায় টঙ ঘর। পাহাড়েও আগের মতো যেখানে সেখানে চাহিদা অনুযায়ী গাছ, বাঁশ পাওয়া যায় না। তবুও নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখনো টঙ ঘরে বসবাস করছি।’
৪নং সুয়ালক ইউপি চেয়ারম্যান উক্যানু মারমা (৫৮) বলেন, আমাদের ইউনিয়নে গ্রাম ঘুরে দেখলে একটিও মাচাং ঘর নাই। শুধু আছে মাঝের পাড়া একটি মাত্র মাচাং ঘর। কালের পরিবর্তনে কারনে আজ বিলুপ্তি হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, মানুষের হাতে কিছু অর্থ থাকলে তা দালান ঘর বানিয়ে ফেলে। কেবা ঐতিহ্য ধরে রাখবে। আগে হতে এখন শিক্ষা ব্যবস্থা বেড়ে গেছে। শুধু প্রতিযোগীতা চলে বাড়ি বানানো নিয়ে। তবে আমাদের সবার উচিত নিজেদের ঐতিহ্য গুলো ধরে রাখা ।
পরিবেশ অধিদফতরে জুনিয়র কেমিস্ট আব্দুল সালাম বলেন, ‘পাহাড়ের ১১টি জনগোষ্ঠী দীর্ঘযুগ ধরে টঙ ঘরে বসবাস করে আসছেন। টঙ ঘর তৈরিতে প্রাকৃতিক গাছ, বাঁশ, ছন প্রয়োজন হয়। তবে এখন আর পাহাড়ের টঙ দেখা যায় না বললেই চলে।’তিনি আরও বলেন, ‘দেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ, বাংলাদেশ এখন সারাবিশ্বে রোল মডেল, প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে দেশ দূর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে পাহাড়েরও সবকিছু পরিবর্তন হচ্ছে।
+ There are no comments
Add yours