প্রসঙ্গঃ কোর্ট ম্যারেজ এবং পারিবারিক অশান্তি | মোঃ রায়হান আলী

Estimated read time 1 min read
Ad1

মোঃ রায়হান আলী

আজকাল সমাজে হরহামেশাই আমারা শুনতে পাই কোর্ট ম্যারেজের কথা। ইংরেজী Misnomer শব্দের অর্থ হল ভুল অর্থে শব্দের প্রয়োগ। আর প্রকৃতপক্ষে এই কোর্ট ম্যারেজ শব্দটিও ভুল অর্থে সমাজে প্রচলিত শব্দ। কোর্ট ম্যারেজ বলতে যে বিয়ে প্রচলিত সেটা ধর্মীয় মতে বৈধ নয় এবং এর আইনগত ভিত্তি ও বৈধতা কিছুই নেই। এটি একটি লোকমুখে প্রচলিত শব্দ মাত্র।

প্রচলিত অর্থে কোর্ট ম্যারেজ বলতে সাধারণত হলফনামার মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিয়ের ঘোষণা দেওয়াকেই বোঝানো হয়ে থাকে। এ হলফনামাটি ২০০ টাকার ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লিখে নোটারি পাবলিক কিংবা প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে মুসলিম বিয়ের ক্ষেত্রে “The Muslim Family Laws Ordinance, 1961 এর বিধিবিধান মানা হয় যা একটি শরীয়াভিত্তিক আইন। যেহেতু আমাদের দেশ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ তাই ধর্মীয় অনুশাসন বা বিধি-বিধান মেনে আইনগত ভাবে বিয়ে করলে সে বিয়ে বৈধ বলে বিবেচিত হবে।

সাধারনত বর-কনে যে অঞ্চলে বসবাস করে সে অঞ্চলের নিকাহ্ রেজিষ্ট্রার দ্বারা বিয়ে সম্পন্ন করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। কিন্তু বর কনে চাইলে নিজের ইচ্ছা ও সুবিধা মত দেশের যে কোন স্থানের নিকাহ্ রেজিষ্ট্রার দ্বারা নিকাহ্ বা বিয়ে সম্পন্ন করতে পারে। সেক্ষেত্রে মুসলিম আইন অনুযারী বর-কনে উভয়ের পক্ষ থেকেই দু’জন পুরুষ এবং একজন নারীর উপস্থিত সাক্ষী হিসেবে থাকা বাধ্যতামূলক।

The muslim marriages and divorces(Registration)Act,1974 অনুযায়ী প্রতিটি বিবাহ নিবন্ধন করতে হবে। এটাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যে বিয়েতে স্বয়ং নিকাহ রেজিষ্টার বা কাজীর মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হয় সে ক্ষেত্রে উক্ত বিয়েতে অবশ্যই তৎক্ষণাৎ বিয়েটি রেজিষ্ট্রি করতে হবে। বিবাহের দিন বা কোন কারণে বিবাহটি রেজিষ্ট্রি করা সম্ভব না হলে,ধরে নেয়া যাক;একজন নিকাহ রেজিষ্ট্রার ব্যতিত অন্য কেউ যেমন কোনো মাওলানা বা হুজুরের মাধ্যমে বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে বিয়ে যেদিন হবে সেদিন থেকে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট নিকাহ্ রেজিষ্ট্রারের কাছে গিয়ে বিয়ে নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে। আর এই নিয়ম অমান্যকারীদের জন্য রয়েছে শাস্তির বিধান। মুসলিম আইন অনুযায়ী বিবাহ নিবন্ধন না করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এমন অপরাধীর বিচারক্রমে ২ বৎসর বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ৩০০০ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড প্রযোজ্য হতে পারে। প্রচলিত ‘কোর্ট ম্যারেজ’ খ্যাত হলফনামার শর্তাবলীতেও লেখা থাকে পরবর্তীতে বিবাহ নিবন্ধন করে নেওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু ক’জনেই বা পরবর্তীতে নিবন্ধন করে থাকে। এই হলফনামা সম্পাদনের মাধ্যমেই বর-কনে নিজেকে সামাজিকভাবে স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে সমাজে বসবাস শুরু করে। এমন কোর্ট ম্যারেজ সাধারনত কিছু কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছেলে-মেয়ের প্রেমের সম্পর্কের ক্ষেত্রেই বেশি হয়ে থাকে।

এ থেকে বাদ যায়না স্কুল,কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীও। উঠতি বয়সের তরুন-তরুনীরা যেহেতু বেশিরভাগই লেখাপড়া জানা,বুঝা (যদিও আইন বিষয় তেমন ধারনা থাকেনা) তাই তারা মনে করেন কোর্টে গিয়ে কোর্ট ম্যারেজ করলেই মনে হয় স্বাভাবিক বিয়ের চেয়ে আরো শক্ত-পোক্ত ভাবে এ বিয়েটার কাজ সম্পন্ন হয়।

পরবর্তীতে হয়তবা তাদের অবিভাবকও এটাকে নাকচ করতে পারবে না। এমনও হয় ছেলে কিংবা মেয়ে যে কোন এক পক্ষই এ কোর্ট ম্যারেজের আসল আইনী ভিত্তি জেনে,বুঝেই আরেক পক্ষের সাথে প্রতারনার মাধ্যমে অবৈধ সুবিধা অর্জনের জন্য এমনটা করে থাকেন। আর এই প্রতারনায় সবচেয়ে বেশি শিকার হয় ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বেশি। ফলে মুসলিমদের কোর্ট ম্যারেজ খ্যাত হলফনামা সম্পাদনে অধিকার বঞ্চিত হয় মেয়েরা;থাকেনা দেনমোহর পাবার অধিকার সহ অন্যান্য।

যেহেতু প্রেমজ সম্পর্ক(Love affair) থেকেই বেশি কোর্ট ম্যারেজের হলফনামা সম্পাদন হয় সেহেতু সম্পাদনের পরে কোর্ট ম্যারেজের আসল আইনী ভিত্তি জানতে পেরে হয়তবা পারিবারিক চাপে কিংবা নিজে যে কোন পক্ষ এটাকে সহজেই অস্বীকার করে। অনেকে পারিবারিকভাবে বিষয়টি নিস্পত্তি করার চেষ্টা করে কিন্তু যেহেতু অবিভাবক ছাড়া সিন্ধান্ত ছিল ছেলে-মেয়ের তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা আর সমাধানের দিকে আলোর মুখ দেখে না। প্রথমত হয়তবা গ্রাম্য সালিশ থেকে শুরু হয় বিষয়টি সমাধানের তাই ভাগ্য ভাল হলে সঠিক সমাধানের উপায় খুঁজে পাওয়া যায়;নয়তবা  শুরু হয় বিপত্তি। হয়ত তখন নেমে আসে দু’পক্ষের পারিবারিক সংঘাত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তখন শুরু হয় কনের উপর বর পক্ষের পারিবারিক সহিংসতা।

তাতেও ক্ষ্যান্ত হয়না;দিয়ে দেয় হয়তবা নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে তালাক। ঠিক যেভাবে ভুল পথে বিয়ে নামক সম্পর্ক সৃস্টি হয়েছিল সেভাবেই তা নিস্পন্ন। যে পক্ষ অস্বীকার করে তার প্রতিপক্ষ বর কিংবা কনে যেই হোক সে ভুক্তভোগী হয়ে আসল বিয়ের বৈধতা সম্পর্কে বিজ্ঞ আইনজীবীগনের দারস্ত হয়।

ঠিক তখনি কোর্ট ম্যারেজের প্রকৃত তথ্য পেয়ে যায় ভুক্তভোগী;উম্মোচন হয় সত্যের। এবার যদি ভুক্তভোগী কনে হয় তাহলে তো বিপত্তির উয়ত্তা নেই। প্রচলিত কোর্ট ম্যারেজ পরবর্তী সন্তান জন্ম লাভ করলে তার বৈধতায় অভিভাবকত্ব,বিবাহ বিচ্ছেদ,দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধার, মোহরানা,ভরণপোষণ সহ আনুষঙ্গিক প্রতিকার নিয়ে ভুক্তভোগী হয়তবা পারিবারিক আদালতে মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েন। ভুক্তভোগীর বিপত্তি মূল যায়গায়;নেই বিবাহের বৈধতার রেজিষ্ট্রি কাবিননামা;আছে কোর্ট ম্যারেজ খ্যাত হলফনামা। তাতে কি মামলা মোকদ্দমায় ভুক্তভোগী সঠিক বিচার পাবে?নিশ্চয় উপযুক্ত পন্থায় বিয়েটা না হওয়ায় ন্যায় বিচার বহির্ভুত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ভুক্তভোগীর। আদালতের বারান্দায় ন্যায় বিচার পাবার আশায় দিনের পর ঘুরতে ঘুরতে জীবনের একটা সময় অতিক্রম করে ফেলে।
যাঁরা সময় থাকতে বুঝলো ভুল পথে পা বাড়ানোর বিষয়টা তারা তো ভুল শোধরানোর সময় পেল। আর যারা মনের রাগ,ক্ষোভ সংবরণ করতে পাড়লো না তাদের জন্য আরো বিপদ। চলতে থাকে সামনের দিকে;এগিয়ে চলে ভাল ফল প্রত্যাশার স্বপ্নে। বিজ্ঞ আইনজীবী ব্যতিত কিছু দালাল শ্রেণীর লোক আছে গ্রামে-গঞ্জে ও আদালতপাড়ার বটতলায় তাদের পরামর্শে দিনের পর দিন মামলা চালানোর ইচ্ছা পোষণ করে বাদিনী। আর তাতে করে একদিকে আর্থীক ক্ষতি অন্যদিকে সময় ও শ্রম ব্যয় কিন্তু বেলা শেষে হয়তবা শূণ্য হাতেই বাড়ি ফেরার পালা। যদি শূণ্য হাতেই বাড়ি ফিরতে হয় তাহলে বিষন্নতাকে সাথে করেই ফিরতে হয়। তখন অনেকে দোষ দেয় ভাগ্যের আবার অনেকে কর্মের। পরাজিত সৌনিকের মত নতুন করে জীবনের সব কিছু শুরু করা সবার পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠে না।
আসলে ভুল পথে ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত হয়তবা অনেককে অনেক বাঁজে ভাবেও এর মূল্য দিতে হয়;নিয়ে ফেলে অনেকে জীবনের চরম সিদ্ধান্ত। একটি ভুল সিদ্ধান্তের জন্য এমন অসম্মান ও অপমান নিয়ে অনেক ভুক্তভোগী নারী কিংবা তাদের পিতা-মাতারা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়ে আত্মহণনের পথও বেঁচে নেয় এমন খবরও আমরা গণমাধ্যমে পেয়েছি। আর যে অবিভাবক বুদ্ধিমানের মত কন্যার জীবনের সব ভুলকে স্বাভাবিক ভুল ভেবে নিয়ে আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করার পরামর্শ দিয়ে পাশে থাকে আসলে তারাই উপযুক্ত অবিভাবক। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী কন্যা অবিভাবকের পরামর্শে কর্ণপাত না করে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে বিষন্নতায় ভোগে।
নারীরা নানা প্রকার কারণে আত্মহণন করে। মূলত পারিবারিক সহিংসতা সংক্রান্তে ডিপ্রেশনে ভোগার বিষয়টিই বেশি। নারী নির্যাতন বন্ধে সরকার নানা প্রকার সেল গঠন এবং নারী নির্যাতন রোধে উপযুক্ত আইনও প্রনয়ন করেছেন। তাতে কি সম্পূর্ণ নারী নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব?নিশ্চয়ই না। সরকারের একার পক্ষে নারী নির্যাতন কিংবা পারিবারিক সহিংসতা বন্ধ করা সম্ভব নয়;হতে হবে জনসাধারণকে সচেতন। শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে সমাজকে। সমাজের কুসংস্কার(Superstition)অনিয়ম(Indiscipline) এগুলো সম্পর্কে জনগণের ধারনা রাখতে হবে। আইন জানা প্রতিটি নাগরিকের নাগরিক দায়িত্ব বটে। আইন সম্পর্কে যদি এদেশের শিক্ষিত জনগণ কিংবা সাধারণ জনগণ ধারনা রাখে তাহলে নোটারী পাবলিকের কোর্ট ম্যারেজের বিয়ে খ্যাত অপশব্দের প্রয়োগের বলির হাত থেকে এ সমাজ রক্ষা পাবে। জানবে আসলটা;বলবে তখন কোর্ট ম্যারেজ বিয়ে সম্পাদন বা রেজিষ্ট্রি নয় বরং বিয়ের হলফনামা বা ঘোষনা মাত্র। তাহলে আর ভুক্তভোগী সহ তার পরিবারকে কোর্ট ম্যারেজের ভুল অর্থের মূল্য দিতে হবে না।

লেখকঃ কলাম লেখক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক,শিক্ষানবিশ আইনজীবী,জজ কোর্ট,খুলনা।

নিজস্ব প্রতিবেদক https://khoborbangla24.net

বিশ্বজুড়ে দেশের খবর

You May Also Like

More From Author

+ There are no comments

Add yours