কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট
আমি একজন শিক্ষক। বলতে দ্বিধা নেই আমি ঘটনাচক্রেই শিক্ষক। আমার নিজেরও জীবনের প্রথম লক্ষ্য শিক্ষক হওয়া ছিলনা। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বিসিএস কর্মকর্তা হওয়ার ইচ্ছা ছিল। আমার মতো আরো অনেকের বেলায়ও এমন লক্ষ্য ছিল। এর যুক্তিসংগত কারণও অবশ্য রয়েছে। নিজের যোগ্যতা কিংবা পরিবারে বাবা, মা হয়তো চাইছিলেন সন্তান তাদের আশা পূরণ করবে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে। স্বাভাবিকভাবে সব বাবা, মায়েরই এমন স্বপ্ন থাকে।
আলোচনায় এখন ‘ঘটনাচক্রে শিক্ষক’। কিছুদিন আগে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে একটা বড় অংশ ঘটনাচক্রে শিক্ষক। যারা হয়তো অন্য কোন পেশায় না গিয়ে এই পেশায় এসেছেন। আমাদের প্রশিক্ষিত শিক্ষক প্রয়োজন।
মন্ত্রী মহোদয় হয়তো ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কথাটি বলেছেন। এই কথার সূত্র ধরে অনেকে অনেক মন্তব্য করেছেন। বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরে নানা বিশ্লেষণ করছেন। আসলে কেনই বা অনেকে ‘ঘটনাচক্রে শিক্ষক’ হচ্ছেন সেটার গভীরে পৌঁছানো জরুরি। জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে গিয়ে খুব বেশি মানুষ পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নেননা। যোগ্যতা বা পরিবারের স্বপ্ন থাকা ছাড়াও এর বিভিন্ন কারণ রয়েছে।
আমার দৃষ্টিতে এসবের মধ্যে প্রথম যে কারণটি, সেটা হলো শিক্ষকতার উপযুক্ত মর্যাদা ও সম্মানীর ঘাটতি। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সুযোগসুবিধার অভাব। একজন মানুষের যখন লক্ষ্য নির্ধারণের সময় আসে তখন সে অন্য অনেককিছুর সাথে উন্নত সুবিধাসম্পন্ন জীবনমানের কথা চিন্তা করে। চিন্তা করে কোন পেশায় গেলে সে তার জীবনকে অনায়াসে সুন্দরভাবে চালিয়ে নিতে পারবে।
কারণ, বাস্তব জীবনে স্বাভাবিক এবং কোন ধরণের চাপ ছাড়া চলতে গেলে আর্থিক ও উপযুক্ত মর্যাদার বিষয়টি মাথায় রাখতে হয়। কেবল সম্মান নিয়ে পেশা ধরে রাখতে চাইলে জীবনে কষ্ট নেমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক সম্মানীত শিক্ষককে দেখেছি জীবনে আর্থিক কষ্টে পড়ে তাঁদের কী দুর্দশাই না হয়েছে! আমাদের প্রিয় শিক্ষকরা কেন এমন কষ্টে থাকবে? এখন তো দেশ অনেক এগিয়েছে।
এবার হলেও তো শিক্ষকদের উপযুক্ত মর্যাদা ও আর্থিক সুবিধাদি দেওয়া সম্ভব। শিক্ষকদের শুধু জাতি গড়ার কারিগর বলে তাদেরকে পর্যাপ্ত আর্থিক সুবিধা /বেতনস্কেল থেকে বঞ্চিত করার কোন কারণ নাই। এসব নিয়ে ভাবা জরুরি। আমি মনে করি শিক্ষক সমাজের জন্য কিছু করার সময় এসেছে।
ঘটনাচক্রে শিক্ষক হবার ক্ষেত্রে আরো একটি কারণ, চাকুরিপ্রার্থীর বিপরীতে পদসংখ্যার অপ্রতুলতা এবং যোগ্যতার চেয়ে লবিং ক্ষমতার দাপট। উপযুক্ত শিক্ষাগতযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এসব কারণে অন্য কোন উপায় না দেখে শিক্ষকতার দিকেই ছুটেন তারা। এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
এখানে, জাতীয় অধ্যাপক যিনি হবেন তাঁর স্থান ওয়ারেন্ট অফ প্রিসিডেন্সের তালিকার ১৭ নম্বরে। সিনিয়র অধ্যাপকের অবস্থান হলো ১৯ নম্বরে। আর প্রাথমিকের শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারি! বেতন ও আর্থিক সুবিধাদিও মর্যাদা অনুযায়ী পাচ্ছেন তারা। এই বৈষম্য এখন সৃষ্টি হয়নি। যুগ যুগ ধরে এভাবেই চলে আসছে।
এ নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথা অাছে বলেও মনে হয়না। শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও এখনো সেটা আলোর মুখ দেখেনি। এ বৈষম্য কিংবা তফাৎ দেখলে শিক্ষকতা পেশার দিকে কেউ পা বাড়াতে চাইবেনা। হয়তো শেষমেশ ঘটনাচক্রেই শিক্ষক হবেন!
ঘটনাচক্রে না হয়ে জীবনের লক্ষ্যই শিক্ষক হওয়া যেন সকলের থাকে সেজন্য উপযুক্ত মর্যাদা ও আর্থিক সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। মুখে শুধু শিক্ষকদের সম্মান দেওয়ার কথা বলে ফেনা তুললে হবেনা। আমরাও চাই কেউ ঘটনাচক্র শিক্ষক না হোক। সবাই পেশা হিসেবে, জীবনের লক্ষ্য হিসেবে শিক্ষকতাকেই বেছে নিক। এজন্য দৃষ্টি আকর্ষণমূলক, প্রয়োজনীয় আর্থিক সুবিধা (উচ্চতর বেতনস্কেল সহ) দিতে হবে। বৈষম্য রোধ করে দিতে হবে শিক্ষকদের প্রাপ্য মর্যাদা।
এমন ব্যবস্থা হোক যেন সকলেই ঘটনাচক্রে না হয়ে স্বেচ্ছায় শিক্ষকতা পেশার দিকে দিকে ছুটে আসতে চায়। তাছাড়া, একই ডিপার্টমেন্টে প্রমোশনে ধীরগতি কিংবা প্রমোশনই না থাকা ইত্যাদি বৈষম্য তো রয়েছে। এসব দেখে কেউ কি শিক্ষকতা পেশায় আসতে চাইবে? হ্যাঁ, বর্তমানে শিক্ষকদের সুযোগসুবিধা, বেতন বাড়ানো হয়েছে আগের চেয়ে বেশি কিন্তু তাও সরকারি উচ্চপদের অপরাপর পদের চেয়ে কম।
এখন যেহেতু ‘ঘটনাচক্র শিক্ষক’ এর বিষয় আলোচনায় এসেছে সেহেতু সব ধরণের বৈষম্য নিরসন করে ‘ঘটনাচক্রে’ না হয়ে সরাসরি শিক্ষকতা পেশার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হোক।
★ লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট
[email protected]
+ There are no comments
Add yours