লায়ন শফিক সোহাগ
প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন থেকেই পত্রিকা পড়ার প্রতি আমার নেশা । তখন বাসায় পত্রিকা নিতো না, তাই এলাকার একটি ফার্মেসীতে (চকবাজারে গাজী ফার্মেসী বা শমসু ভাইয়ের ফার্মেসী নামে পরিচিত) গিয়ে প্রতিদিন পত্রিকা পড়তাম । তখন থেকেই সাহিত্য চর্চার প্রতি ঝোঁক বাড়ে । শুদ্ধ বানান চর্চার জন্য আমি পত্রিকার প্রতি নেশাটাকে কাজে লাগিয়েছিলাম । প্রতিটি শব্দের দিকেই মনোযোগ দিতাম যেনো পরবর্তীতে কোনো শব্দ লিখতে গেলে বানানটি চোখে ভেসে উঠে । আমি বিশ্বাস করতাম সাংবাদিকরা অনেক জ্ঞানী হয়; তাই তাঁদের লিখাগুলো শুদ্ধ । ছোট বেলার সেই চর্চা করে বর্তমান এ বয়সে এসেও আমি যে শুদ্ধ বানানে খুব পারদর্শী হয়ে গেছি তা বলবো না । তবে আমি সেই চর্চা থেকে ভীষণ উপকৃত হয়েছি । পত্রিকা পড়ার নেশা থেকেই সৃষ্টি হয় সাহিত্য চর্চা ও পত্রিকায় লেখা পাঠানোর নেশা । প্রাইমারীতে থাকাকালীন পত্রিকায় অল্প অল্প লিখা শুরু করলেও হাই স্কুলের শেষের দিকে তার গতি বৃদ্ধি পায় । একসময় আরও কিছু সমমনা ব্যক্তিদের সঙ্গ আমাকে লিখালিখির প্রতি আরও বেশি উৎসাহী করে তোলে । চট্টগ্রামের পরিচিত মুখ কলামিস্ট রায়হান আজাদ ভাই, গল্পকার গনি ভাই, কবি আজিজ কাজল ভাই, লেখক শেখর দেব দা সহ আরও অনেকের সঙ্গ আমাকে উপকৃত করেছে । আমরা সাহিত্য নিয়ে আড্ডা দিতাম, সকলেই দৈনিক পূর্বকোণ, আজাদী সহ বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লিখতাম ।
এইচএসসির ছাত্র থাকাকালীন গনি ভাইয়ের সহযোগিতায় অস্ট্রেলিয়ার সিডনীতে আমার লিখা পাবলিশ হয় । বেড়ে যায় উৎসাহ উদ্দীপনা আর সেই সাথে মাথায় চেপে বসে সাংবাদিকতার নেশা । বেশ কয়েকটি সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণ কোর্সও করে ফেললাম । সাংবাদিকতার উপর কয়েকটি সার্টিফিকেট অর্জন করেও সংবাদ এবং সাংবাদিকতার উপর ব্যাপক পড়াশুনা শুরু করে দিলাম । খ্যাতিমান অনেক সাংবাদিক সহ তৎকালীন সাংবাদিক নেতাদের কাছ থেকে দীক্ষা নেওয়ারও সৌভাগ্য হয় আমার । ২০০৮ সাল হতে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হতে থাকে ‘মাসিক চট্টগ্রাম বার্তা’ পত্রিকা । একসময় বিজ্ঞাপনের অভাব এবং সাংবাদিকতার এই অঙ্গনটিতে কিছু দুষ্ট লোকের আনাগোনা দেখে এই পেশার প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলি । পরবর্তীতে স্কুলের শিক্ষকতা, তারপর থেকে এখন পর্যন্ত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর চাকরীর কারণে সাংবাদিকতার মহান পেশার সাথে দূরত্ব আরও বৃদ্ধি পায় । দীর্ঘ অনেক গুলো বছর পর ইউটিউব ভিত্তিক চ্যানেলের নতুন আইডিয়া পেয়ে সাংবাদিকতার প্রতি পুরনো নেশাটা আবার বিগড়ে উঠে । তাই ২০১৭ সাথে চালু করলাম একটি ইউটিউব চ্যানেল । বেশ ভালোই চলছিলো । তখন চট্টগ্রামে সি প্লাস ছাড়া আর তেমন কোনো চ্যানেল চোখে পরেনি (হয়তো ছিল) । হঠাৎ খেয়াল করলাম এখানেও আনাগোনা শুরু করে দিয়েছে দুষ্ট লোক আর তাদের প্রজন্মরা । চায়ের দোকানে কাজ করা ছেলেটাও দেখি ইউটিউব টিভি চ্যানেল খুলে বসে আছে ! আবার কয়েকজনের দেখলাম রয়েছে একাধিক চ্যানেল ! হাতের মোবাইলটি দিয়েই অন্যের ভিডিও ডাউনলোড করে চালায় এসব চ্যানেল ! মনটা আবারও ভেঙে গেলো । নিজের চ্যানেলের পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ হলো । মানুষ যদি আমাকেও গতানুগতিক ওইসব চ্যানেল ওয়ালাদের মতই ভাবে ! বন্ধ রাখলাম চ্যানেলের কাজ ।
ইদানিং ফেসবুকে কিছু পোস্ট দেখে মেজাজটা আর স্থির রাখতে পারছি না । পোস্টগুলো ঠিক এমন – ‘মাত্র ১৫০০ টাকায় তৈরি করুন নিজের নিউজ পোর্টাল আর ক্যারিয়ার গড়ুন সাংবাদিকতা পেশায়’, ‘মাত্র ২০০০ টাকায় ইউটিউব টিভির মালিক হউন আর শুরু করে দিন সাংবাদিকতা’ ! অনেকেই আবার এভাবে সস্তায় ডোমেন কিনে আগডুম নিউজ২৪, বাগডুম ক্রাইম নিউজ, ঘোড়াডুম টিভি, অমুক পত্রিকা-তমুক নিউজ ইত্যাদি খুলে কপি পেস্ট-ডাউনলোড আপলোড সিস্টেম ফলো করে নিজেদের সাংবাদিক দাবি করে বেড়াচ্ছেন আর এই পরিচিতিকে পুঁজি করে জড়িয়ে পরছেন বিভিন্ন ক্রাইমে । খুব জানতে ইচ্ছে করে সাংবাদিকতা কি এতোটাই সহজ বিষয় ? সস্তা বিষয় ? তারা কি জানেন সংবাদ আর সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য কি ? তারা কি জানেন সংবাদ আর প্রতিবেদনের পার্থক্য কি ? তারা কি জানেন প্রতিবেদনের প্রারম্ভিক স্তর হতে পরিশিষ্ট অংশ পর্যন্ত কয়টি ধাপ এবং কোন ধাপে কি উল্লেখ করতে হবে ? তারা কি রীতিসিদ্ধ প্রতিবেদন, রীতিবিরুদ্ধ প্রতিবেদন, প্রার্থীত প্রতিবেদন, অপ্রার্থীত প্রতিবেদন, সাময়িক প্রতিবেদন, বিশেষ প্রতিবেদন এসবের অর্থ বুঝেন ? তারা কি সংবাদ লিখার বিভিন্ন কাঠামো সম্পর্কে বিন্দু পরিমাণ ধারণা অর্জন করেছেন ? তারা কি সংবাদের উল্টো পিরামিড কাঠামো, ডায়মন্ড কাঠামো, স্ক্রু কাঠামো, সেন্টিপিড কাঠামো, ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল কাঠামো এসব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছেন নাকি এসবের নামও শুনেছেন ? সাংবাদিকতার খুঁটিনাটি যোগ্যতা অর্জন তো দূরে থাক ভালো করে বাংলা বলতে বা লিখতে পারছেন তারা ? কপি পেস্ট ছাড়া নিজে থেকে একটি লাইন লিখতে গেলে ঐ লাইনের প্রতিটা শব্দই ভুল ! ইউটিউব টিভি খুলে সংবাদ পাঠ করছেন – রিপোর্ট করছেন অথচ কথা স্পষ্ট নয়, উচ্চারণ গুলো ভুল আর হাস্যকর ! ‘চলে যাচ্ছে’ কে ‘ছলে জাচ্চে’, ‘কথা হয়’ কে ‘কতা অয়’, ‘সেখানে রাখবে’ কে ‘সেকানে লাকবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি ! যারা নিজেরাই শুদ্ধ লিখতে পারেন না, বলতে পারেন না তাদের কাছ থেকে অন্যরা কিভাবে শুদ্ধতা শিখবে ? এই মানুষগুলো ভিজিটিং কার্ড বানিয়ে সাংবাদিক পরিচয় বিক্রি করে অপরাধ করে যাচ্ছেন দেদারছে । তাদের লাগাম টানা জরুরী । তা নাহলে সাংবাদিকতার মহান পেশাটি কলুষিত হবে, সাংবাদিক শব্দটি সাধারন মানুষের কাছে গালি হিসেবে ব্যবহৃত হবে । তাই সচেতন মানুষ সহ সাংবাদিক নেতাদের প্রতি অনুরোধ – এদের থামান ।
লেখক: কলামিস্ট
Email: [email protected]
+ There are no comments
Add yours