ড মুহাম্মদ নুর হোসাইন
সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
হযরত আদম ও হাওয়া (আ.)-এর বিয়ে হয়েছিল জান্নাতে। সেই বিয়েতেও মোহর (মাহর) নিধার্রিত ছিল বলে বর্ণনা আছে। তবে সেটি দৃশ্যমান কোন বস্তু ছিল না। শেষ নবি হযরত মুহাম্মদ (দ.)-এর প্রতি তিন বা বিশবার দরূদ পাঠের মাধ্যমে তাঁদের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। জান্নাতে তাঁদের কোন সন্তান-সন্ততি ছিল না। পৃথিবীতে তাঁদের সন্তান-সন্ততি হয়। পৃথিবীতে আসার পর তাঁদের মাঝে যোগাযোগ ছিল না দীর্ঘদিন। এরপর সাক্ষাৎ হয় পবিত্র আরাফাত ময়দানে। আরাফাত মানে পরিচিতি। উভয়ের নতুনভাবে সাক্ষাৎ ও পরিচিতির কারণে এটার নাম আরাফাত হয়েছে মর্মে একটি তথ্য পাওয়া যায়। এরপর পৃথিবীতে তাঁদের সংসার গড়ে উঠে। সন্তান-সন্ততি হয়। আল্লাহ তায়ালার একান্ত ইচ্ছায় তাঁদের ঔরসে যমজ সন্তান হতো। একটি পুত্র, অপরটি কন্যা। তখন যমজ ভাই-বোন সহোদর হিসেবে বিবেচিত হতো। যমজদের মাঝে বিয়ে নিষিদ্ধ ছিল। পূর্ববতীতে জন্ম নেয়া সন্তান-সন্ততির সাথে পরবর্তীদের বিয়ে হতো। এভাবে পৃথিবীতে মানুষ ছড়িয়ে পড়েছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “হে মানব, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে একটি আত্মা থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে। আর তাঁদের উভয় থেকে বহু নারী-পুরুষের বিস্তার ঘটিয়েছেন” (সূরা নিসা: ১)।
প্রত্যেক নবি (আ.)-এর শরিয়তে যৌনমিলন বৈধ হওয়ার মাধ্যম ছিল বিবাহ পদ্ধতি। বিবাহ পদ্ধতির বাইরে গিয়ে নারী-পুরুষের মিলন মানে ব্যভিচার আর সে সূত্রে জন্ম নেয়া সন্তান-সন্ততি জারজ হিসেবে বিবেচিত। তাই হযরত ঈসা (আ.)-কে প্রথমে তৎসমাজের লোকেরা জারজ মনে করেছিল। কারণ, তাঁর জন্মগ্রহণ ছিল অলৌকিক। অবিবাহিতা মহিলা হযরত মরিয়ম (আ.) থেকে তাঁর জন্ম। অথচ তিনি ছিলেন সতী-সাধ্বী রমনী। যখন ফেরেস্তা এসে তাঁকে এক পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দেন তখন তিনি বললেন, “আমার পুত্র হবে কেমন করে? আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি আর আমি ব্যভিচারিণীও নই” (সূরা মরিয়ম: ২০)। ব্যভিচারিণী মনে করা হবে- এমন ভয়ে তিনি লোকালয় থেকে দূরে চলে গিয়েছিলেন। চিন্তিত ছিলেন সমাজকে কী জবাব দেবেন। প্রসববেদনা শুরু হলে তিনি বললেন, “হায়! আমি যদি এসব কিছু ঘটার পূর্বে মারা যেতাম! মানুষের স্মৃতি থেকে পুরোপুরি মুছে যেতে পারতাম” (প্রাগুক্ত, ২৩)। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রমাণিত হয় যে, যুগে যুগে ব্যভিচার ও অসামাজিক কার্যকলাপের প্রতি সভ্যসমাজের ঘৃণা ছিল এবং ব্যভিচার সর্বশরিয়তে নিষিদ্ধ ছিল। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থেও ব্যভিচারকে বড় পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে নারী-পুরুষের মিলনের বৈধ পন্থা হলো বিবাহ ব্যবস্থা।
“সুন্নতি বিয়ে” ও “ফাতেমি মোহর” বলে দুটি কথা মুসলিম সমাজে প্রচলিত আছে। বিয়েকে সুন্নাত হিসেবে জানে সবাই। বিয়ে করা সুন্নাত- কথাটি সত্য হলেও সব বিয়ে সুন্নতি নয়। অর্থাৎ বিয়ের কার্যক্রম সুন্নাত তরিকা মতে হলে সেটি সুন্নতি বিয়ে। এর ব্যতিক্রম হলে সেটি সুন্নতি নয়। “বিয়ে করা সুন্নাত” বিষয়টিও ইসলামি আইনশাস্ত্রবিদদের মতে আপেক্ষিক। অর্থাৎ কারো জন্য ফরজ, কারো জন্য সুন্নাত, কারো জন্য মুবাহ আবার কারো জন্য নাজায়েয। শারিরীক ও আর্থিক সঙ্গতি থাকা না থাকা এবং পাপে লিপ্ত হওয়া না হওয়ার সম্ভাবনার আলোকে এর বিধান নির্ধারিত হয়। ইমাম শাফেয়ি (র.)-এর মতে পাপে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে বিয়ে করার চেয়ে একাকী জীবনে ইবাদত-বন্দেগি করা উত্তম। মূলকথা হলো, পবিত্র কুরআন-সুন্নাহতে বিয়ের ক্ষেত্রে শারিরীক ও আর্থিক সঙ্গতিকে শর্ত করা হয়েছে। যাদের সেই সঙ্গতি নেই তাদেরকে সংযম করার জন্য বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, “যাদের বিয়ের সক্ষমতা নেই, আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে সক্ষম না করা পর্যন্ত তারা যেন সংযম অবলম্বন করে” (সূরা নূর: ৩৩)। সংযমের অন্যতম মাধ্যম হলো রোজা পালন করা। যেমন পবিত্র হাদিসে বলা হয়েছে, “হে যুব সমাজ, তোমাদের মধ্যে যার বিয়ের সামর্থ্য আছে সে যেন বিয়ে করে নেয়। কেননা, সেটি মানুষের চোখকে অবদমিত করে আর লজ্জাস্থানকে সুরক্ষা দেয়। যার সামর্থ্য নেই সে যেন রোজা পালন করে। কেননা, এটি কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে” (বুখারি, হাদিস নং-৫০৬৬)।
বিয়ের উদ্দেশ্য হলো পাপ মুক্ত থাকা আর সুসন্তান জন্ম দেয়া। শুধু যৌন চাহিদা মিটানোর উদ্দেশ্যে বিয়ে করাকে ইসলামি শরিয়া নিয়ত হিসেবে গ্রহণ করে না, যদিও পূর্বোক্ত নিয়তে বিয়ে করলেও যৌন চাহিদা পূরণ হয়। কিন্তু নিয়তের প্রভাব পড়ে বাস্তব ক্ষেত্রে। তাই প্রত্যেক আমলের ন্যায় বিয়ের ক্ষেত্রেও নিয়ত পরিশুদ্ধ হওয়া জরুরি। পাশাপাশি বিয়ের সর্বকাজ সুন্নাত তরিকা মত হওয়া উচিৎ। বর্তমান সময়ে বিয়েকে উপলক্ষ করে নানান কুসংস্কার, যৌতুক, অপসংস্কৃতি, অপচয় ইত্যাদির চর্চা চলছে। এগুলো সুন্নতি বিয়ের সাথে সাংঘর্ষিক। সুন্নতি বিয়ে হবে পারিবারিক সিদ্ধান্তে এবং সুস্থ সংস্কৃতি ও সামাজিকতা রক্ষা করে। অবশ্য, প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে ছেলে-মেয়ের মতামত দেয়ার অধিকার সংরক্ষিত আছে ইসলামি আইনে। পাত্র-পাত্রীর উভয় পক্ষ সম্মত হওয়া বিয়ের রুকন বা আবশ্যকীয় বিষয়। অন্তত দু’জন সাক্ষীর উপস্তিতিতে অভিভাবক অথবা তার পক্ষ থেকে নির্ধারিত প্রতিনিধি (উকিল) আক্দ সম্পন্ন করবে। মোহর নির্ধারণ করা হবে। জুমার দিন মসজিদে আকদ হবে। অন্য দিন ও স্থানে হওয়াও জায়েয। বারো মাসের যে কোন মাসে বিয়ে হতে পারে। কন্যার অভিভাবক বা তার প্রতিনিধি বিয়ের প্রস্তাব করবে। ছেলে তা কবুল করবে। প্রস্তাব ও কবুল যে কোন পক্ষ থেকে হতে পারে। বিয়ের প্রচার করাও জরুরি। রাসূলুল্লাহ (দ.)-এর আমলে দফ বাজিয়ে প্রচার করা হতো। একাধিক হাদিসে বিয়ে উপলক্ষে দফ বাজানো ও অপ্রাপ্ত বয়স্কদের ভাল অর্থপূর্ণ গান গাওয়ার বর্ণনা এসেছে। এর লক্ষ্য হলো বিনা প্রচারে, সাক্ষী বিহীন, মোহর ছাড়া ও গোপনে যেন বিয়ে না হয় এবং ব্যভিচারের সাথে বিয়ের পার্থক্য সূচিত হয়। কারণ, ব্যভিচার রোধ করার জন্য বিয়ে ব্যবস্থা। সামর্থ্য থাকলে বিয়ের পর ছেলের পক্ষ থেকে ওয়ালিমা করা হবে। অন্তত একটি ছাগল দিয়ে হলেও ওয়ালিমা করার কথা হাদিসে এসেছে। পক্ষান্তরে একান্ত নিজের পছন্দ ও সিদ্ধান্তের বিয়েতে বরকত থাকে না। এমন বিয়ে ভেঙ্গে যায় সহজে। যৌতুক নেয়া হারাম। বৈরাতি খাওয়ানোর জন্য চাপাচাপি জায়েয নেই, বরং জুলুম। কন্যাপক্ষ থেকে নগদ টাকা বা বিভিন্ন আসবাবপত্র সরাসারি অথবা আকার-ইঙ্গিতে দাবি করাও নাজায়েয। দাবি না করলেও বর্তমান সমাজে যেগুলো যৌতুক হিসেবে পরিচিত সেগুলো গ্রহণ করলেও যৌতুক হিসেবে পরিগণিত হবে। বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে পরিবারকে অবজ্ঞা করা যাবে না। সামাজিকতা রক্ষা করতে হবে। তবে সামাজিকতার নামে অপচয়, বিজাতীয় সংস্কৃতিচর্চা, অতি আড়ম্বরতা ও চাপাচাপি করা যাবে না। মূলত বিয়ে মানে আক্দ তথা চুক্তি অনুষ্ঠান। এক পক্ষের প্রস্তাব আর অপর পক্ষের কবুলের মাধ্যমে যা সংঘটিত হয়। বর্তমানে এ কাজটিকে অবজ্ঞা করা হয় আর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় বিবাহোত্তর আপ্যায়ন আর আনুষ্ঠানিকতাকে। অতি আপ্যায়ন আর আনুষ্ঠানিকতা করতে গিয়ে অনেক পরিবার ফতুর অথবা ঋণগ্রস্ত হয়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে সংসার জীবনে। বিয়ের পর একদিকে খরচ বেড়ে যায়, অপরদিকে ঋণ পরিশোধের চাপ থাকে অথবা অভাব দেখা দেয়। ফলে সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হয়। এমনকি অনেক সংসারও ভেঙ্গে যাওয়ারও আসল কারণ বিয়েতে অতি খরচ।
মোহর বিয়ের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিয়ে উপলক্ষে পাত্রের পক্ষ থেকে পাত্রীকে নগদ অর্থ, সোনা-রুপা বা মূল্যমান জিনিষ প্রদান করাকে মোহর বলা হয়। এটিকে পবিত্র কুরআনে ছদাক, নিহ্লা, আজার, ছাদুকা ইত্যাদি বলা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য বিবাহ বন্ধনকে গুরুত্ব দেয়া, নারীর প্রতি সম্মান ও ভালবাসা প্রদর্শন, স্বামীর উদ্দেশ্যের সততা প্রমাণ, স্ত্রীর আর্থিক প্রয়োজন মিটানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতা ইত্যাদি। মোহরের উদ্দেশ্য মানুষ বেচা-বিক্রি নয়, বরং দৃঢ় বন্ধন সৃষ্টি করা এবং বন্ধনকে গুরুত দেয়া; যেন যেনতেনভাবে নারীপুরুষের মিলন না ঘটে। পাশাপাশি “যখন ইচ্ছা গ্রহণ করলাম আর যখন ইচ্ছা ছেড়ে দিলাম”- নীতি পরিহার করা, যা জাহিলি যুগে প্রচলিত ছিল। মোহর এর পরিমাণ পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই, যদিও একাধিক আয়াতে মোহরের প্রদানের দাগিদ দেয়া হয়েছে। পবিত্র হাদিসে মোহরের নূন্যতম পরিমাণ দশ দিরহাম বলা হয়েছে, যার বর্তমান মূল্য ২৯১৭ টাকা প্রায়। আল্লাহর নবি (দ.)-এর অধিকাংশ স্ত্রীর মোহর ছিল পাঁচশ দিরহাম। হযরত উম্মে হাবিবা (র.)-এর মোহর ছিল চারশ দিনার তথা সতেরোশ গ্রাম (প্রায় ১৬৪ ভরি) স্বর্ণ। অবশ্য, এর প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন এবং এটি আদায় করেছিলেন হাবশার (ইথিওপিয়ার) বাদশা নাজ্জাশি। আল্লাহর নবি (দ.)-এর কন্যাদের মোহর ছিল বারো উকিয়্যা তথা ১৪০ তোলা রুপা। হযরত ফাতিমা (র.)-এর মোহর ছিল একটি বর্ম, যার মূল্য ছিল চারশ বা চারশ আশি দিরহাম। দ্বিতীয় পরিমাণটি অধিক বিশুদ্ধ। এর বর্তমান বাজারমূল্য এক লাখ চল্লিশ হাজার টাকা। এটাকে ফাতেমি মোহর বলা হয়। অতএব বুঝা গেল, মোহরের সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়নি। কিন্তু অতিরিক্ত মোহর নির্ধারণের প্রতি অনুৎসাহিত করা হয়েছে। হযরত ওমর (র.) বলেন, “তোমরা মোহর নির্ধানের ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন করিও না। যদি অতিরিক্ত মোহর পার্থিব সম্মান আর আল্লাহর নিকট খোদভীতি হিসেবে বিবেচিত হতো তাহলে তোমাদের চেয়ে আল্লাহর নবি (দ.) সেটির বেশি উপযুক্ত ছিলেন। তিনি তাঁর স্ত্রী ও কন্যাদের ক্ষেত্রে বারো উকিয়্যার বেশি মোহর নির্ধারণ করেননি” (ইবন মাজাহ, হাদিস নং-১৮৮৭)। বর্তমানে বৈরাতি খাওয়ানো, আসবাবপত্র, পোষাকসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার মাধ্যমে যেমনি কন্যাপক্ষ থেকে যৌতুক দাবি করা হচ্ছে তেমনি অতিরিক্ত মোহর নির্ধারণ করাও পাত্রের প্রতি অবিচার। বেশি মোহরে সম্মান আর কম মোহরে অপমান বোধ করার কিছু নেই। এটি যৌক্তিক পর্যায়ের হওয়া উচিৎ। পাত্র-পাত্রীর শিক্ষা-দীক্ষা, আদব-কায়দা, আর্থিক অবস্থা, শিষ্ঠাচার, বংশমর্যাদা ইত্যাদির বিবেচনা করে এবং নির্বাচিত পাত্রের সামর্থানুযায়ী মোহর নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত মোহর নির্ধারণ করার অন্যতম উদ্দেশ্য থাকে কন্যার ভবিষ্যৎ জীবনের নিশ্চয়তা। এটাকে গুরুত্বহীন বলা যায় না। তবে মোহর নির্ধারণের ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন সুন্নতের খেলাপ। পবিত্র হাদিসে বলা হয়েছে, “যে বিয়েতে যোগান (আড়ম্বরতা) কম সেটি অধিক বরকতময় বিয়ে” (বায়হাকি, হাদিস নং-৬১৪৬)।
+ There are no comments
Add yours