বাংলাদেশ থেকে প্রথম আমেরিকায় অভিবাসী হয়েছিলেন কে? এই প্রশ্নের সঠিক কোন উত্তর জানা যায় না। তবে কখন, কিভাবে মার্কিন মুল্লুকে বাঙালিদের বসতি গড়ে উঠেছিল; তাদের ত্যাগ, সংগ্রাম ও সফলতার অনেক কথামালা অবশ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সেই ইতিহাসকে ধারণ করার উদ্দেশ্যেই কবি ও লেখিকা সোনিয়া কাদির একটি অনবদ্য বই লিখেছেন। বইটি মূলত তার অভিবাসী পিতার সংগ্রাম ও লড়াই করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার গল্প নিয়ে লেখা। তবে এর পরতে পরতে উঠে এসেছে আমেরিকায় কিভাবে থিতু হয়েছিলেন অভিবাসীরা। কিভাবে অভিবাসীদের মাধ্যমেই গড়ে উঠলো আজকের স্বপ্নের আমেরিকা; সেইসব ইতিহাস।
সোনিয়া কাদিরের বইটির ভাষ্য অনুযায়ী, ১৯২০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় ভারতীয়দের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। ইমিগ্রেশনের কড়াকড়ির ফলে এখানে ভারতীয় অভিবাসীর সংখ্যা সেই হারে বাড়ছিল না। বইটির তথ্য অনুযায়ী, ১৯২০ সালের দিকে আমেরিকার সুপ্রীম কোর্ট ভারতীয়দের নাগরিকত্ব পাওয়ার বিরুদ্ধে রায় দেয়। তখন সোনিয়া কাদিরের বাবা নবাব আলী জাহাজে কাজ করার সুবাদে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াতেন। সেই সময়টায় তিনি ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকা, আমেরিকা থেকে আফ্রিকাগামী জাহাজে চলাচল করতেন। তখন তার বাবা একবার যাত্রাপথে নিউইয়র্কে থেকে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন। তবে অভিবাসীদের জন্য সময়টা ভালো না হওয়ায়, সেবার তিনি চলে যান। পরবর্তীকালে নবাব আলী ১৯২৮ সালে আবারো গিয়ে আমেরিকায় থেকে যান।
১৯০৬ সালের ১৫ এপ্রিল সিলেটের বিয়ানীবাজারের ছোটদেশ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সোনিয়া কাদিরের বাবা নবাব আলী। এরপর কিভাবে তিনি জাহাজের খালাসি হয়ে উঠছেন, হলেন গৃহত্যাগী সেইসব গল্প উঠে এসেছে বইটিতে। ১৯২৮ সালে আমেরিকায় গেলেও নবাব আলী সেখানে গ্রীন কার্ড পেয়েছিলেন দীর্ঘ সময় পর, ১৯৪২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। পেন্সিলভেনিয়ার ফিলাডেলফিয়া থেকে সেই কার্ড ইস্যু হয়েছিল। সেই সময়টায় কাজের কারণে গোটা আমেরিকা ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। তবে দিনগুলো মোটেও সহজ ছিল না। একসময় নিউইয়র্কে ফিরে আসেন নবাব আলী। সেখানে ১৯৪৫ সালের ২৭ অক্টোবর পুয়ের্তেরিকান বংশোদ্ভূত জুয়ানিতা মোরালেসকে বিয়ে করেন। সেই সংসারে দুই ছেলে জোনাব আলী ও লুইস আলী। তবে মতের মিল না হওয়ায় ভেঙে যায় সেই বিয়ে।
সোনিয়া কাদির মূলত কবিতা লিখে সুনাম কুঁড়িয়েছেন। তবে এবার বৃহৎ কলেবরের এই ইতিহাসনির্ভর সাহিত্য রচনা করলেন তিনি। বাংলার সঙ্গে বইটিতেই ইংরেজি অনুবাদও যুক্ত করা হয়েছে। আছে ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ নানা তথ্য, ছবি ও দলিলাদী। ২০২২ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বইটি প্রকাশিত হয়েছে। বইটার প্রচ্ছদ করেছেন অরূপ বাউল। আর বইটি প্রকাশ করেছে মেঘদীপা প্রকাশন। বাংলাদেশের বাইরে লন্ডন ও নিউইয়র্কেও পাওয়া যায় বইটি।
সোনিয়া কাদির বইটিতে লিখেছেন, ‘পাখি উড়ে গেলে পালক ফেলে যায়। মানুষ মারা গেলেও স্মৃতি রেখে যায়। অতীত কখনও মুছে যায় না। বর্তমান ও ভবিষ্যতের মাঝেই লুকিয়ে থাকে। সমাজ, সভ্যতা ও মানুষের রেখে যাওয়া, ঘটে যাওয়া নিদর্শন, যুগ যুগান্তর ধরে মানবসভ্যতার চলমান জীবনধারাই-মানবের জীবন সংগ্রামের চমকপ্রদ ইতিহাস’। আর বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে থাকা অভিবাসীদেরকে।
+ There are no comments
Add yours