বিকেল ৫টা বেজে ৫৪ মিনিট। দিনের জরুরি সব কাজ সেরে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম। চট্টগ্রাম নগরীর এ. কে. খান মোড়ের আগে এক যায়গা আছে ‘ইস্পাহানী গেইট’।
পকেটে ৭০ টাকা নিয়ে দাড়ালাম টেম্পুর জন্য। উদ্দেশ্য বহদ্দারহাট মোড়। গণপরিবহনে গেলে ভাড়া পরবে প্রায় ৩০ টাকা। অন্যসময় হলে খরচটা ২০ টাকা হতো। তেল এর দাম বাড়াতে হিসাবে এখন ১০ টাকা বেশি যুক্ত হয়েছে।
এসব ভাবতে ভাবতে এক রাইডার এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ‘যাবেন?’। ‘হোন্ডা ১১০ সিসি মোটরসাইকেল’, মুখে মাস্ক। বুঝলাম আনঅফিসিয়াল রাইডার। আমাদের শহরে অফিসিয়ালদের চেয়ে আনঅফিসিয়ালরাই বেশি। বাইক থাকলেই রাইড শেয়ার করে দুই পয়সা পেলে মন্দ কি? আমার এক বন্ধু তো কোথাও যাওয়ার আগে রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। সাথে কেউ গেলে ১০০ টাকা লাভ। অনেকে নিরাপত্তার কথা বললেও ব্যক্তিজীবনে এই আনঅফিসিয়াল বাইকগুলাতে বেশি চরেছি। এদেরই ভাল লাগে।
যাক ৭০ টাকা পকেটে নিয়ে রাইড শেয়ার করে বহদ্দারহাট কি, জিইসিও যাওয়া যাবে না। মানা করে দিলাম। বললাম যাব না। না বলে মোটরসাইকেলের দুরে গিয়ে দাঁড়ালাম। ৬/৭ মিনিট পার হলো। না সেই রাইডার কোন পেসেঞ্জার পেলেন, না আমি কোন টেম্পু। এবার সন্ধ্যা নিকটে ঘনিয়ে এলো। রাইডার এসে আমাকে বললেন,
‘চলেন ভাই, যা আছে দিয়েন’
-‘আমার টাকা নেই ভাই, সরি।’
‘আরে যা আছে দিয়েন, আমি নিচ্ছি’
-‘আমার কাছে শুধু টেম্পুর ভাড়া আছে ভাই’
‘আচ্ছা সমস্যা নাই আমি চলে যাচ্ছি আমার সাথে চলেন’
-‘না না ধন্যবাদ আমি যেতে পারব’
‘উঠেন ভাই’
-‘আমার কাছে কিন্তু টাকা নাই’
‘আরে উঠেন’
তারপর কি? উঠে গেলাম…এবার কয়েক মিটার যেতেই আমার কৌতূহল জাগলো উনি আমাকে ফ্রিতে নিতে চাইছেন কেন। নাম জিজ্ঞেস করলাম শুরুতে। বললেন ‘অঞ্জন বিশওয়াস’। আমি অঞ্জন বুঝলাম। পরেরটা বুঝলাম না। জিজ্ঞেস করলাম প্রফেসনাল নাকি। উনি বললেন না, পার্টটাইম। আজকে আগে কাজ শেষ করতে পেরেছেন তাই দুই পয়সা অতিরিক্ত উপার্জন করতে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়েছেন।
কথাবার্তা খুবই স্মার্ট। শিক্ষিত মনে হলো। আমার কৌতূহল বেড়ে গেলো। উনার নামের পরের অংশটা জানার ইচ্ছা হলো। আবারও জিজ্ঞেস করলাম। উনি আবারো বললেন ‘বিশওয়াস’। রাস্তায় এত ভিড়ের মধ্যে আমি উনার হিন্দী উচ্চারণ বুঝতে পারলাম না। বললাম বুঝিনাই, উনি বুঝিয়ে দলেন ‘বিশ্বাস’।
আমি প্রাথমিকভাবে নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, ‘আজ আসলে হাতে টাকা নেই, সরি’। উনি বললেন, ‘সমস্যা নাই, আপনাকে না নিলে আমার একা যেতে হতো।’ অভাবের চেয়ে একাকীত্ব ভয়ংকর। আমার আবার এমন মিশুক মানুষ খুবই পছন্দ। জীবনে এমন মানুষদের সাথেই বেশি চলি। উনি আরও বললেন, কাজ না থাকলে ঘরে বসে ভাল লাগে না তাই ছেলেমেয়েদের জন্য ভাল কিছু নেওয়ার উদ্দেশ্যে রাইড শেয়ারে নেমেছেন। সন্ধ্যার পর স্ত্রী-সন্তানদের সময় দেবেন তাই এখনই চলে যাচ্ছেন।
আমি এবার অনুমতি নিতে চাইলাম। অনুমতি কিছু প্রশ্ন করার। উনি মিশুক মানুষ আর কি করবেন, সম্মত হলেন। জিজ্ঞেস করলাম আপনি কি করেন? তিনি বললেন স্বনামধন্য এক ওষুধ কোম্পানিতে কাজ করেন। আর এ কারণে সব রাস্তাঘাট পরিচিত আছে। নিজ সম্পর্কে খুব স্বাচ্ছন্দ্যে সব বলে যাচ্ছিলেন। ২০০২ সালে রাঙ্গামাটি থেকে বিএ পাশ করে জীবনে শুধু একটি চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছেন। আজও সেই চাকরিতে আছেন।
আমার জন্মসাল ২০০২। তাই আর ভাইয়া না বলে আংকেল সম্বোধন করলাম। মাস্ক পড়ে ছিলেন। মোটরসাইকেল চালালে কেন জানি সবাইকে যুবকের মত লাগে। এবার উনার পারিবারিক কথায় গেলাম। উনিও বলতে থাকলেন। যা শুনলাম তা আমার মনকে পানি করে দিল।
মধ্যবিত্ত মানুষগুলোর জীবনের চাওয়া-পাওয়া খুবই কম। থাকার জন্য ডাবল বেডরুমের একটা ঘর, বউ-বাচ্চা নিয়ে সংসার আর দুইবেলা খাওয়ার জন্য একটি চাকরি। তিনিও ব্যতিক্রমী নন।
মধ্যবিত্তদের জীবনের সাফল্যগুলোও সরল ও সুন্দর। সেই রাইডারের ছেলে চট্টগ্রামের শীর্ষ এক সরকারি স্কুলে ৬ষ্ট শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। ক্লাসের ১৮৬ জনের মধ্যে শুধু ১৪ জন সকল বিষয়ে পাশ করেছেন। তার ছেলে সেই ১৪ জনের মধ্যে একজন। এটাই উনার উল্লেখ করা সাফল্য।
যেতে যেতে এবার রাস্তায় বিশাল ট্রাফিক জ্যাম। আমি ফোন কলে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।এই ফাকে রসিক মানুষটা তার মিশুক স্বভাব বরাবরে প্রমাণ করতে আশপাশের অন্যান্য বাইকার, সিএনজিওয়ালাদের সাথে আড্ডা শুরু করে দিলেন। মূহুর্তে জ্যামের মধ্যে একটা হাস্যরস পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেল। আমি অজান্তে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, ‘আপনি এমন কেন?’ তিনি বললেন ‘মানুষকে হাসাতে ভাল লাগে’। আমাদের ছন্ন-বিষন্ন জীবনটাতে দুই মিনিট হাসি উপহার দেওয়ার মানুষ খুবই কম। রাস্তাঘাটে খুশি দেওয়ার মানুষ পেলে ভালই লাগে।
আমি তারপর নিজের আসল নিয়ত বলেই দিলাম। আমি উনাকে নিয়ে লিখতে চাই আর লেখাটা প্রকাশ করতে চাই। তিনি অনুমতি দিলেন। আর অনুমতি দেওয়ার পর জিজ্ঞেস করলেন উনাকে নিয়ে কেন লিখতে চাই। আমি বললাম ‘আপনার মত ভাল মানুষদের অমর হওয়ার অধিকার আছে। স্বার্থপর পৃথিবীতে আপনার মত নিঃস্বার্থ ও প্রানবন্দ মানুষের অমর থাকা দরকার। মানুষ লেখার মাধ্যমে অমর হয়’। উনি হেসে বললেন এত সুন্দর করে কেউ আমার স্ত্রীর জন্য চাকরি দিতে চাইলে আরও বেশি খুশি হতাম। অতঃপর আমরা এক গুরুত্বপূর্ন আলাপে ব্যস্ত হয়ে পরলাম।
২ নাম্বার গেইট আসতেই আমি নেমে গেলাম। অধির আগ্রহে আংকেলের নাম্বারটা নিয়ে যোগাযোগ রাখতে বললাম। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হাতে থাকা ৭০ টাকা থেকে ৫০ টাকা দিতে চাইলাম। কিন্তু তিনি নিলেন না।
‘আমি তোমাকে ফ্রি-তে আনছি, আমার লাগবে না’
-প্লিজ এটা আমি মন থেকে দিচ্ছি
‘না আমি কমিটম্যান্ট করেছি, টাকা নিব না’
-না আপনার এটা নিতে হবে(জোড় করে পকেটে দিতে চাইলাম)
‘না দিয়েন না, আমার একটা ক্লাস আছে। আমি মন থেকে আনছি’
-আর কিছু বলার থাকলো না। আমার কাছে থাকা একটি কলম দিয়ে বললাম ‘এটা আপনার ছেলের জন্য’
‘আমি এটা নিব, ধন্যবাদ’
-আপনার একটা ছবি নিতে পারি?
‘(মাস্ক খুলে) হ্যা নেন, আমার নতুন কাট
কেউ আমার জন্য কিছু করলে লাগে আমার নিজেকে ঋণগ্রস্ত মনে হয়। কিন্তু এই রাইডারের ব্যবহারে একবারও নিজেকে ঋণী মনে হলো না। মনে হল এটাই মানবতা। মানবতা সকলেরই প্রাপ্য। পৃথিবীর সকল মানুষের এমনই হওয়া উচিত।
আর হ্যা, বড় বড় গাড়িবাড়ি থাকলেই কেউ বড়লোক হয়না, বড়লোক হতে উদার মন ও মানবিকতা দরকার। শুভ কামনা অঞ্জন বিশ্বাস।
+ There are no comments
Add yours