জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী রোববার (১১ সেপ্টেম্বর) রাত ১১টা ৪০ মিনিটে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)।
৮৭ বছর বয়সে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যান তিনি।
১৯৩৫ সালের ৮ মে মাগুরা জেলায় মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। তার বাবার নাম সৈয়দ শাহ হামিদ উল্লাহ এবং মা সৈয়দা আছিয়া খাতুন। তার বাবার বাড়ি ফরিদপুরের সালথা উপজেলায়।
তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কান্ডারি। সাজেদা চৌধুরী দীর্ঘ দিন অসুস্থ ছিলেন। গত তিন বছর অসুস্থতার কারণে তিনি রাজনৈতিকভাবে কোনো কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতেন না।
বঙ্গবন্ধুকে ভাই ডাকতেন সাজেদা চৌধুরী। সেই সুবাদে শেখ হাসিনা তাকে ‘ফুপু’ বলে ডাকায় তিনি ‘আওয়ামী লীগের ফুপু’ হিসেবেও পরিচিত। গত দুই-তিন বছরে মাঝে মাঝেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। এই অবনতির কারণে এলাকার মানুষের মনে সংকট সৃষ্টি হয়েছিল।
প্রথমে তার বড় ছেলে আয়মন আকবর চৌধুরী এবং পরবর্তীতে কনিষ্ঠ পুত্র শাহাদাত চৌধুরী লাবু সালথা নগরকান্দায় মায়ের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে আসছিলেন।
শিক্ষাজীবনে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তার স্বামীর বাড়ি ছিল চট্টগ্রামে। স্বামী গোলাম আকবর চৌধুরী ছিলেন রাজনীতিবিদ এবং সমাজকর্মী। ব্যক্তি জীবনে তিনি তিন ছেলে ও এক মেয়ের জননী। সাজেদা চৌধুরীর ছিল এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন।
১৯৫৬ সালে প্রত্যক্ষভাবে সাজেদা চৌধুরী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যোগ দেন। ১৯৬৯-১৯৭৫ সময়কালে তিনি বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
১৯৭০-এর নির্বাচনে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনেও তিনি জয়লাভ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন তিনি কলকাতা গোবরা নার্সিং ক্যাম্পের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। ১৯৭২-১৯৭৫ সময়কালে তিনি বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন বোর্ডের পরিচালক, ১৯৭২-১৯৭৬ সময়কালে বাংলাদেশ গার্ল গাইডের জাতীয় কমিশনার ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৯১ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রদত্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে টেকনোক্র্যাট কোটায় বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়।
২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি ফরিদপুর (ফরিদপুর-২ নগরকান্দা, সালথা ও সদরপুরের কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন) থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। রাজনীতিবিদ হিসেবে সাজেদা চৌধুরী কতটা সহনশীল ছিলেন, তা তখন তার কথা ও কাজে বোঝা গিয়েছিল। ফরিদপুরের ওই আসনে সব সময় সাজেদা চৌধুরী তুখোড় প্রতিদ্বন্দ্বী থাকতেন বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব ওবায়দুর রহমান।
২০০৭ সালে শামা ওবায়েদকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। পরে ২০০৯ সালে সরকার তাকে সংসদের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব দেন। যা তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ওই আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন মিলিয়ে পর পর টানা তিনবার তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এলাকার উন্নয়নেও সাজেদা চৌধুরী রেখেছেন অভূতপূর্ব অবদান। তার প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালে ৭ দশমিক ৫৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে নগরকান্দা উপজেলার নগরকান্দা ইউনিয়ন ও লস্করদিয়া ইউনিয়নের অনেকাংশ ভেঙে নগরকান্দা পৌরসভা গঠন করা হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ১৭টি ইউনিয়নের বৃহৎ উপজেলা নগরকান্দা ভেঙে সালথা উপজেলা পরিষদ গঠন করেন।
পরবর্তীতে জাকজমকপূর্ণ ভবন ও সাজসজ্জায় সাজান সালথা উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স। বানান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবন। তার চেষ্টায় সরকারিকরণ হয় নগরকান্দা মহাবিদ্যালয় ও শত বছরের প্রাচীন বিদ্যাপীঠ মহেন্দ্র নারায়ণ একাডেমি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এছাড়া এলাকার রাস্তাঘাট নগরকান্দা আধুনিক থানা ভবনসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নও করেন তিনি। তবে তার আশা ছিল নগরকান্দাকে জেলায় রূপান্তর ও সেখানে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা।
ফরিদপুরের নগরকান্দা ও সালথার মানুষের কাছে তিনি ছিলেন এক জনপ্রিয় নেত্রী। তার জনপ্রিয়তা ছিল কিংবদন্তিতুল্য। তার মৃত্যুতে ফরিদপুরের রাজনৈতিক মহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের চরম দুর্দিনে আপসহীন কান্ডারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। এ কারণেই আওয়ামী লীগে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত।
+ There are no comments
Add yours