আজিজুল হক চৌধুরীঃ
১৯৬৫ সালে যখন চলছে আইয়ুব-মোনায়েমের পাক শাসন। এদেশীয় দোসর মুসলিম লীগের দোরাত্ম্য। তখন শহীদ মিনার গড়া তো দেশদ্রোহিতার সামীল। ভয়-ভীতিকে তুচ্ছ করে ছাত্র ইউনিয়নের এক সভায় কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। সবাই তাতে সম্মতি দেন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে শহীদ মিনার নির্মাণের আবেদন করা হলে মিলে ছাত্রত্ব হারানোর হুমকি।
ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে ২০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে স্কুল পর্যায়ে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। পরদিন সকালে নবনির্মিত এ শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনে ছাত্র-জনতার ঢল নামে। জনস্রোতে পরিণত হয় বিদ্যালয় প্রাঙ্গন।
এভাবে বোয়ালখালীর প্রথম শহীদ মিনার গড়ার কথা জানা যায় ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন বোয়ালখালী উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি সৈয়দুল আলমের কাছে।
তিনি বললেন, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না পেলেও যেকোনো ত্যাগের বিনিময়ে শহীদ মিনার গড়ার প্রতিজ্ঞা ছিল আমাদের। শেষতক কৌশল নেওয়া হল, স্থানীয় প্রভাবশালীদের আয়ত্বে এনে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হবে। সেই অনুযায়ী, আমার পিতা উত্তর আকুবদন্ডীর ইউপি সদস্য কামাল উদ্দিনকে টেকানোর দায়িত্ব ছিল আমাদের দুই ভাইয়ের। সেইমতে দুইভাই মিলে তাকে নমনীয় করা হল। কিন্তু দক্ষিণ আকুবদন্ডীর সদস্য সৈয়দ জামাল উদ্দিন আহমদকে ঠেকানো যাচ্ছে না। তার ভাগনে আবুল হাসানের দায়িত্ব পড়ল তাকে প্রতিরোধ করার।
বিদ্যালয়ের ধর্মীয় শিক্ষক মাওলানা ইসমাইলের নেতৃত্বে প্রতিরোধকারী শিক্ষকেরা বিদ্যালয়ে সামনে, আমরা এককোণে অবস্থান নিই। শিক্ষকদের অমান্য করে শহীদ মিনার গড়ার কাজ শুরু করতে পারছেন না ছাত্ররা। রাত পেরিয়ে যাচ্ছে। প্রতিরোধ ভাঙ্গনের প্রবল স্পৃহা জাগে তাঁদের তরুণ হৃদয়ে। শেষতক শাহজাদা সৈয়দ রেজাউল করিম আকবরী লুঙ্গি-গামছা পেঁচিয়ে কোদাল নিয়ে নেমে গেল। ছাত্রদের রুদ্র ও বিপ্লবী মূর্তি দেখে শিক্ষকেরা বিদ্যালয় প্রাঙ্গন থেকে সরে গেল। আনন্দ-উচ্ছ্বাসে সবাই নেমে পড়ল শহীদ মিনার নির্মাণে। বিজয়োল্লাসে পিরামিট আকৃতির শহীদ মিনার করা হল। তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম সভাপতি (সাবেক মন্ত্রী) আবদুল্লাহ-আল-নোমানের সহায়তায় এ শহীদ মিনার নির্মাণ হয়।
শহীদ মিনার নির্মাণের সেই রাতে যারা উপস্থিত ছিলেন, মরহুম আবুল হাসান, সৈয়দ নুরুল হুদা, মাহবুব উল আলম, ফরিদ উদ্দিন জালাল, পিযুষ চৌধুরী, মিলন নাথ, যোগব্রত বিশ্বাস, আবদুছ সত্তার, দুলাল মজুমদার, মোহাম্মদ আলী, আবুল কালাম আজাদ, ওসমান, এস এম ইউছুফ, তসলিম উদ্দিন, জাকির হোসেনসহ আরও কয়েক জন।
প্রথম প্রহরেই কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজসহ বিভিন্ন বিদ্যালয় থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল সহকারে নবনির্মিত শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনে আসতে থাকেন। বিকেল গড়তে ছাত্র-জনতার স্রোতে পরিণত হয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গন। শুরু হয় আলোচনা সভা, কবিতা আবৃত্তি ও গান। ভাষাসৈনিক মাহবুবুল আলম চৌধুরী, তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের জেলা সভাপতি আবদুল্লাহ-আল-নোমানসহ অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রথম দিনই উপস্থিত ছিলেন। পরের বছর থেকে এই শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে আয়োজন করা হয় জমজমাট একুশ মেলার নানা আয়োজন। বিভিন্ন সময়ে এখানে এসেছেন -ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন চৌধুরী, নাট্যকার মমতাজ উদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক আবু জাফর, ড. আবুল কালাম মনজুর মোর্শেদ, ড. অনুপম সেন, চিত্রশিল্পী রশিদ চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, সবিউল আলমসহ বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ। তাঁদের উপস্থিতিতে মুখরিত থাকত একুশ মেলা। একুশ মেলার অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা জানানো হয় অনেক ভাষাসৈনিকদের।
জানা গেছে, ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন পাকবাহিনী ও এদেশীয় দোসরেরা প্রথম শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে ফেলে। দেশ স্বাধীনের পর বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নতুন করে শহীদ মিনার নির্মাণ করে। ৭২ সালের পর থেকে বিভিন্ন স্থানে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হলে এই শহীদ মিনারের কদর কমতে থাকে। জাতীয় দিবসে এলাকাভিত্তিক কয়েকটি সংগঠন ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাড়া অন্য সংগঠনগুলোর আগ্রহ কমে যায়। হারিয়ে যায় একুশের জাতীয় অনুষ্ঠানমালা ও জৌলস।
+ There are no comments
Add yours