শাহিনুর রহমান সোনা, রাজশাহী:
সম্প্রতি পদন্নোতি পেয়ে রাজশাহী আঞ্চলিক শিক্ষা দফতরের উপ-পরিচালক (কলেজ) হয়েছেন মাহবুবুর রহমান শাহ্। কিন্তু ওএসডি’তে আগের পদেই বহাল রয়েছেন তিনি। তারপরও মাত্র এক বছরেই গড়ে তুলেছেন ‘এমপিও সিন্ডিকেট’। কিন্তু এমপিও প্রক্রিয়ায় সবার প্রথমে সহকারী প্রোগ্রামারের নজরেই ধরা পড়ে ভুল-ত্রুটি।
সততার সাথে কাজ করায় উপ-পরিচালকের রোষানলে পড়তে হয় সহকারী গ্রোমারকে। অভিযোগ উঠেছে, ডলি রানীর সৎ কর্মে ‘এমপিও বাণিজ্যে’ ব্যাঘাত ঘটায় তদবির করে বদলি করানো হয়েছে।
সূত্র বলছে, গত ২২ ডিসেম্বর তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেন মাউশির যুগ্ম প্রোগ্রাম পরিচালক প্রফেসর ড. সামসুন নাহার। এর দুই দিন পর বৃহস্পতিবার (২৪ ডিসেম্বর) বিষয়টি টের পান মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা দপ্তরের রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর ড. কামাল হোসেন। ওই দিনই তিনি এই আদেশ বাতিল চেয়ে চিঠি দেন মহাপরিচালক বরাবর।
এ পর্যন্ত পাঁচ ধাপে ১১শ বেসরকারি কলেজ শিক্ষক ও কর্মচারীর এমপিও আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে রাজশাহী অঞ্চলে। এমপিও আবেদন যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় পরিচালক ও সহকারী পরিচালককে কারিগরি সহায়তা দিয়ে আসছেন সহকারী প্রোগ্রামার ডলি রানী পাল। আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের প্রথম ধাপেই আর্কাইভসে রক্ষিত নথিতে গড়মিল ও ত্রুটি ধরা পড়ে তার চোখেই। আর এ কারণে তিনি ‘চোখের বালি’ রাজশাহীর আঞ্চলিক শিক্ষা দপ্তর কেন্দ্রীক এমপিও সিন্ডিকেটের।
অভিযোগ উঠেছে, প্রতিবারই এমপিও প্রক্রিয়া শুরু হলে ‘আবদার’ ও ‘তদবির’ নিয়ে আসছেন রাজশাহী আঞ্চলিক শিক্ষা দপ্তরের উপ-পরিচালক (কলেজ) মাহবুবুর রহমান শাহ্। শিক্ষা দপ্তর কেন্দ্রীক এমপিও সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণও তার হাতেই। শিক্ষক-কর্মচারীদের ফাঁদে ফেলে প্রতিবারই মোটা অংকের অর্থ বাণিজ্য করছে চক্রটি।
নিজেকে এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ‘কাছের লোক’ পরিচয় দেন মাহবুবুর রহমান শাহ্। এই পরিচয়ে এমপিও ছাড়ে তদবির এমনকি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভয়-ভীতি ও চাপ দেয়ার অভিযোগও উঠেছে। কয়েকটি কলেজের এমপিও প্রত্যাশী শিক্ষকেরা বিষয়টি স্বীকারোত্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে দৈনিক আমাদের সময় প্রতিবেদকের কাছে।
সম্প্রতি স্থানীয় এমপি ও মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার দুটি এবং বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলার দুটি কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীর এমপিও ছাড় দেয়ার ‘আবদার’ করেন মাহবুবুর রহমান শাহ্। কিন্তু পরিচালকের নির্দেশে আর্কাইভ ঘেটে এই আবেদনগুলোর দোষ-ত্রুটি তুলে আনেন সহকারী প্রোগ্রামার। এতে আটকে যায় এমপিও।
শেষে এমপিও ছাড়ে অনৈতিক প্রস্তাবও দেন মাহবুবুর রহমান শাহ্। তাতেও সাড়া না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে পরিচালক ও সহকারী পরিচালককে দেখে নেয়ার হুমকি দেন। আর তাদের সহযোগী হিসেবে সহকারী প্রোগামারকে বদলির হুমকি দেন। এর ১৫ দিনের মাথায় সহকারী প্রোগামার ডলি রানী পালের বদলির আদেশ এলো।
আঞ্চলিক শিক্ষা দফতরের একটি সূত্র জানাচ্ছে, অনলাইনে এমপিও আবেদন জমা পড়ার পর সেটি যাচাই-বাছাই করে অগ্রায়ণ করেন সহকারী পরিচালক (কলেজ) ড. আবু রেজা আজাদ। এই ধাপে তাকে কারিগরি সহায়তা দেন সহকারী প্রোগ্রামার ডলি রানী পাল।
ড. আবু রেজা আজাদের অগ্রায়ণের পর আবেদন চলে যায় উপ-পরিচালক (কলেজ) মাহবুবুর রহমান শাহের কাছে। যাচাই-বাছাই করে তিনি সেটা পাঠিয়ে দেন পরিচালক বরাবর। আবেদন চূড়ান্ত নিষ্পত্তির এই ধাপেও পরিচালককে কারিগরি সহায়তা দেন সহকারী প্রোগামার।
কিন্তু অনুসন্ধান বলছে, ফাইল হাতে পাওয়ার পর হিসাব কষেন মাহবুবুর রহমান শাহ্। এমপিও প্রার্থীদের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করে ফাইল আটকানোর ভয়-ভীতি দেখিয়ে মোটা অর্থ আদায় করেন।
কখনো কখনো এমপিও আবেদন শুরুর আগেই কৌশলে এমপিও প্রাপ্তির বিষয়টি জেনে নেন এই কর্মকর্তা। তারপর এমপিও ছাড় দিতে রকম ভেদে ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত চুক্তি করেন প্রার্থীর সাথে। আর এই কাজ বাগাতে নানান কৌশলে কর্মকর্তাদের জিম্মি করেন মাহবুবুর রহমান শাহ্।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সহকারী প্রোগামারের এমপিও নিষ্পত্তিতে কোনো ভূমিকা নেই। তিনি কেবল ‘টেকনিক্যাল’ সহযোগী হিসেবে পরিচালককে সহায়তা করেন। আর এ কারণেই এমপিও সিন্ডিকেটের প্রথম টার্গেট ডলি রানী পাল। পরিচালক ও সহকারী পরিচালককে চাপে ফেলতে ‘তদবির’ করে তাকে বদলির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা দপ্তরের রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই এখানকার কিছু কর্মকর্তা নানানভাবে কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করে আসছেন। বিষয়টি তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। কাজের সুষ্ঠু পরিবেশে ফেরাতে করণীয় কী সেটিও তিনি জানিয়েছেন।
ডলি রানী পালের বদলির আদেশের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিচালক বলেন, টেকনিক্যাল পার্সন হিসেবে তিনি দক্ষতা, নিষ্ঠা ও যোগ্যতার সঙ্গে দাপ্তরিক কাজে সহায়তা করে আসছেন। এছাড়া ইজিপি টেন্ডার কার্যক্রমেও তিনি দক্ষতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দেন। এই কর্মকর্তার বদলি দাপ্তরিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করবে। এই আদেশ বাতিল চান পরিচালক।
অভিযোগ বিষয়ে উপ-পরিচালক (কলেজ) মাহবুবুর রহমান শাহ্ বলেন, ‘এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। এমপিও প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকলেও তার ভূমিকা সেইভাবে নেই। কাজেই এই সংশ্লিষ্ট কেউকে হুমকি-ধামকি দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এমপিও পাইয়ে দিতে কাউকে প্রলোভন কিংবা ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগও ভিত্তিহীন।’
ইতিপূর্বে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করে মাউশির যুগ্ম প্রোগ্রাম পরিচালক প্রফেসর ড. সামসুন নাহার জানান, রাজশাহীতে এমপিও কাজের পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। তবে সেখানে কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
এ ছাড়া সহকারী প্রোগ্রামার ডলি রানী পালের বদলি বিষয়ে জানতে চাইলে প্রফেসর ড. সামসুন নাহার বলেন, ‘ডলি রানী পালকে রুটিন অনুযায়ী বদলি করা হয়েছে। তবে তাকে কেউ হুমকি-ধামকি কিংবা চাপ প্রয়োগ করে থাকলে প্রমাণ সাপেক্ষে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর বদলি বিষয়টি পুনর্বিবেচনা যোগ্য।’
+ There are no comments
Add yours