চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের ‘স্বেচ্ছাচারিতার’ প্রতিবাদে গত বৃহস্পতিবার জাতীয় পার্টি (জাপা) ঢাকা মহানগর উত্তরের সহস্রাধিক নেতাকর্মী আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে দল থেকে পদত্যাগ করেছেন।
সদ্য অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকে নানা ইস্যুতে দলে অস্থিরতা চলমান। এই গণপদত্যাগ সেই অস্থিরতারই বহিঃপ্রকাশ। ১৯৯০ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা হারানোর পর থেকে দলটিতে ভাঙাগড়া চলছে। আবারও ভাঙনের মুখে সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দল জাপা।
দলটির বর্তমান ও সাবেক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভাঙনের ইতিহাস এই দলে নতুন নয়। সব সময় কোনো না কোনো ইস্যুতে দলটিতে অস্থিরতা লেগেই থাকে। এক সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শাসক এরশাদও দলে ভাঙন, বিবাদ ঠেকাতে পারেননি। বিশেষ করে নির্বাচনকেন্দ্রিক বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করায় বিরক্ত দলের নেতাকর্মীরা।
নির্বাচনের বাইরে নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল যেন জাপার নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরশাদবিহীন দলের এই অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। বরং দিন দিন মূলধারার জাপায় অভ্যন্তরীণ সংকট আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ছোট ছোট দল আর উপদলে বিভক্তি-কোন্দল বাড়ছে দলটিতে।
জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপাই মূল ধারা হিসেবে পরিচিত। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এই ধারায় এখন বেশ কয়েকটি উপধারা সৃষ্টি হয়েছে। এরশাদের মৃত্যুর পর দেবর-ভাবির মধ্যে নেতৃত্বের কোন্দলে রওশনপন্থিরা পৃথক দল গঠনের চেষ্টায় রয়েছেন। গৃহবিবাদের জেরে এই অংশটি এবারের নির্বাচনেও অংশ নেয়নি।
এর মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য, প্রার্থীদের কোনো প্রকার সহযোগিতা না করাসহ দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনেন পার্টির পরাজিত প্রার্থীরা। তারা দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের পদত্যাগ দাবি করেন। ঘেরাও করা হয় বনানীর জাপা চেয়ারম্যানের কার্যালয়। এরপর সারা দেশের পরাজিত প্রার্থীদের ডেকে বিশেষ সভাও হয়েছে।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দলের একজন কো-চেয়ারম্যানসহ অন্তত চারজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অনেকের নাম দলের ওয়েবসাইট থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে পরাজিতদের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর কমিটিও বিলুপ্ত ঘোষণা করেন দলপ্রধান জি এম কাদের। তবে পরাজিত প্রার্থীদের দখলে এখনো দলটির কাকরাইলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়।
এসব নিয়ে আবারও জাপায় ভাঙনের গুঞ্জন তীব্র। তবে মূল ধারার এই অংশটি রওশনের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত যুক্ত হবে, নাকি পৃথক দল গঠন করবে, এ নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা রয়েছে।
১৯৮২ সালে সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাপার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৯০ সালে তার পতনের পর থেকে ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু দলটি। এর মূল কারণ হিসেবে বারবার ভাঙনকে দায়ী করছেন পার্টির অনেকেই।
১৯৯০ সালে ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত দলটি ছয়বার ভাঙনের মুখে পড়ে। এরশাদের জীবদ্দশায় পাঁচবার এবং তার মৃত্যুর দুই বছর পর আর একবার ভাঙে দলটি। এর বাইরে মূলধারায় এখন মূলত জি এম কাদের, রওশন এবং নির্বাচনের পর ক্ষুব্ধ অংশ—এই তিন ধারা রয়েছে।
সর্বশেষ এরশাদের পুরোনো রাজনৈতিক সহকর্মী কাজী জাফর আহমেদ দলটিতে ভাঙন ধরান। অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ৭ শতাংশের কিছু বেশি ভোট পায় দলটি, আসন কমে হয় ১৭টি।
পরের তিনটি নির্বাচনে জাপা অংশ নিয়েছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে। দেখা গেছে আওয়ামী লীগ যেসব আসনে ছাড় দিয়েছে, কেবল সেখানেই জিতে আসতে পারছেন লাঙ্গলের প্রার্থীরা। এরশাদের মৃত্যুর পর তার সাবেক স্ত্রী বিদিশার নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি পুনর্গঠনের ঘোষণা দেন বিদিশা সিদ্দিক।
জাতীয় পার্টি হিসেবে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধন রয়েছে চারটি দলের। যারা বিভিন্ন সময় ভাঙনের পর পৃথক দল গঠন করে। এরশাদের নেতৃত্বাধীন মূল অংশটি লাঙল প্রতীকে ইসিতে নিবন্ধিত। এ ছাড়া আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জেপি নিবন্ধিত বাইসাইকেল প্রতীক নিয়ে; নাজিউর রহমান মঞ্জুর বিজেপি নিবন্ধিত গরুর গাড়ি প্রতীক নিয়ে; ডা. এম এ মুকিতের নেতৃত্বাধীন কাঁঠাল প্রতীকের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির নিবন্ধন রয়েছে। কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ও বিদিশার নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিসহ আরেকটি অংশনের নিবন্ধন নেই।
+ There are no comments
Add yours