বাংলাদেশের জন্ম নিবন্ধনের তথ্য যেসব সার্ভারে থাকে সেটি হ্যাক করে নানা মাত্রায় জাল-জালিয়াতির খবর হয়েছে গণমাধ্যমে। তবে গত ছয় মাস ধরে এই জালিয়াতি নতুন মাত্রায় হচ্ছে, যা উদ্বেগজনক।
কারণ, মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নাগরিকদের অনেকে বাংলাদেশিদের সহযোগিতায় পাচ্ছেন ভুয়া জন্মসনদ। মাত্র ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় রোহিঙ্গারা জন্মসনদ নিয়ে বাংলাদেশি পরিচয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট তৈরি করছেন।
পৌরসভার মেয়র, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন সচিবের আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অফিসের কম্পিউটার অপারেটর, ফ্রিল্যান্সার ও অন্যান্য সহযোগীদের সহায়তায় এই জালিয়াতি হচ্ছে বলে তথ্য মিলেছে। ভুয়া জন্মসনদ ব্যবহার করে বাংলাদেশে জমি ক্রয়, চাকরি ও বিদেশ গমনের তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দিনাজপুর জেলার বিরল পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটর মো. আব্দুর রশিদ। একই জেলার বিরলের ১০নং রাণীপুকুর ইউনিয়নের কম্পিউটার অপারেটর সোহেল চন্দ্র। নিয়মানুযায়ী সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ও পৌরসভার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জন্ম নিবন্ধনের কার্যক্রম চলমান ছিল। যেটির কাজ করে আসছিল এই দুই অপারেটর।
সংঘবদ্ধ সাইবার অপরাধী চক্রের মাধ্যমে তারা হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম ও ফেইসবুক গ্রুপে যুক্ত হন। আরও আগে এসব গ্রুপ জন্মসনদ, এনআইডি ও পাসপোর্টসহ বিভিন্ন জাল-জালিয়াতির বিষয়ে চক্রের মধ্যে কথোপকথন ও যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল।
চক্রের প্রলোভনে পড়ে চাহিদা অনুযায়ী, রশিদ ও সোহেল চন্দ্র টাকার বিনিময়ে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া জন্মনিবন্ধন সম্পন্নের পর সনদ সরবরাহ করে আসছিল। গত ছয় মাসে কয়েক শ’ রোহিঙ্গাসহ অন্তত পাঁচ হাজার ভুয়া জন্ম নিবন্ধন তৈরির পর তা সরবরাহ করেছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের(ডিএমপি) সাইবার ক্রাইমের পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু এই ইউপি ও পৌরসভায় নয়, চাহিদা ও গুরুত্ব অনুযায়ী টাকার বিনিময়ে দেশের আরও বেশ কয়েকটি জেলার ইউপি ও পৌরসভা হতে কম্পিউটার অপারেটরদের মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধনের পর সনদ পেয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গা নাগরিকরা। এ বাবদ লেনদেন হচ্ছে বিকাশ, রকেট ও নগদসহ মোবাইল ব্যাংকিং চ্যানেলে।
তারা বলছেন, এসব জালিয়াতিতে ইউপি চেয়ারম্যান, সচিব, পৌরসভা মেয়র ও নির্বাহী কর্মকর্তারা দায় এড়াতে পারেন না। কারণ, জন্মনিবন্ধনের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল নথির বিষয়টি দেখভাল, অনলাইনে এন্ট্রির প্রক্রিয়ায় পিনকোড, পাসওয়ার্ড তাদের কাছে। তাদের অজ্ঞাতসারে এ ধরনের ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্যের ভিত্তিতে স্বপ্রণোদিতভাবে এ সংক্রান্ত একটি মামলা দায়েরের পর তদন্ত শুরু করে ডিএমপির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম(দক্ষিণ) বিভাগ। এরপর তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে গেলো সপ্তাহে বাগেরহাট, নারায়ণগঞ্জ এবং দিনাজপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ভুয়া জন্ম নিবন্ধন এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্ম নিবন্ধনকারী চক্রের ৫ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- দিনাজপুরের বিরল পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটর আব্দুর রশিদ, একই জেলার বিরলের ১০ নং রাণীপুকুর ইউনিয়ন পরিষদের কম্পিউটার অপারেটর সোহেল চন্দ্র এবং তাদের সহযোগী মোস্তাফিজুর রহমান। এছাড়া সরবরাহকারী শহিদুল ইসলাম মুন্না ও রাসেল খান। এ দুজন বাগেরহাট এবং নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা।
দিনাজপুর বিরলের শহিদুল ইসলাম মুন্না ও বাগেরহাটের রাসেল খান পড়াশুনার পাশাপাশি এই জালিয়াতিতে জড়িত। আর নারায়ণগঞ্জের রাসেল খান স্থানীয় একটি গার্মেন্টসের কাজে নিয়োজিত। অনলাইনে যোগাযোগ থেকে মোস্তাফিজুর রহমানের মাধ্যমে গ্রেপ্তার আব্দুর রশিদ ও সোহেল চন্দ্রের সঙ্গে পরিচয় হয় বাকি দুজনের।
হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রাম গ্রুপে তাদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ হতো। ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ তৈরি, বিশেষত রোহিঙ্গা জনগণের জন্ম নিবন্ধন সনদ তৈরিতে ব্যাপক লাভ দেখে তারা কাজে জড়িত হয়ে পড়ে। বহু রোহিঙ্গা জনগণ গ্রেপ্তারদের মাধ্যমে ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ তৈরি করে নিয়েছে। এ কাজে তারা সবাই আনুপাতিক হারে লাভ পেত। শুধু বিরল নয়, কুষ্টিয়া, বি-বাড়িয়াসহ দেশের অন্যান্য পৌরসভা ও ইউনিয়নে তাদের লোকজন রয়েছে। যারা ৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে হাজার হাজার মানুষের ভুয়া জন্ম নিবন্ধন করে দিয়েছে।
ছয়টি করণীয় ও সুপারিশ তুলে ধরে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার(ডিবি) হারুন অর রশীদ বলেন, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো ব্যবহারকারী সবাই তাদের আইডি পাসওয়ার্ড অধস্তনদের কাছে দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। শক্তিশালী প্রযুক্তি দল এবং ইকুইপমেন্ট ব্যবহার করতে হবে।
জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্ম নিবন্ধন সার্ভারসহ গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোতে দুর্বলতা থাকলে দ্রুত সমাধানে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। যথাযথ কর্তৃপক্ষ ব্যতীত ভুয়া জন্ম নিবন্ধন করা থেকে বিরত থাকা। নিবন্ধনকারী কর্তৃপক্ষের মনিটরিং জোরদার করা এবং এ রূপ কোন চক্রের সন্ধান পেলে দ্রুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবগত করা।
+ There are no comments
Add yours