গত এক বছরে অধস্তন আদালতে দুর্নীতির মামলায় সাজার হার প্রায় ৪ শতাংশ কমেছে। এই সময়ে ৩৪১টি দুর্নীতি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৫৭ দশমিক ১৮ শতাংশ মামলায় সাজা পেয়েছেন অভিযুক্তরা।
বিগত পাঁচ বছরের দুদকের দেওয়া চিত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের পর থেকে সাজার এই হার গত বছর ছিল সর্বনিম্ন। পাশাপাশি কমেছে মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যাও। বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতাসহ নানা কারণে ৪০ শতাংশের বেশি দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্তরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জানতে চাওয়া হলে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক বলেন, বিভিন্ন কারণে এটা হতে পারে। আদালত বিচার করে আদেশ দিয়েছেন—এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে চাই না। তবে নানা কারণে সাজা কমতে পারে। হয়তো মামলার তদন্তে ত্রুটি ছিল, মামলায় দুর্বলতা ছিল।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক সময় সাক্ষী মারা যায়, আসামি মারা যায়। মামলার সার্বিক কার্যক্রমে এর প্রভাব পড়ে। আমাদের দেশে প্রয়োজনের তুলনায় জজ অনেক কম। তাই বিচারে দীর্ঘসূত্রতা যাবে না। যদি কোনো মামলায় সাজা সঠিক হয়নি মনে করি, তার বিরুদ্ধে আমরা আপিল করছি।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো অভিযোগ সম্পর্কে অনুসন্ধানে প্রাথমিক সত্যতা পেলে দুদক মামলা করে। মূলত প্রাথমিক অনুসন্ধান ও তদন্তের পর এ ধরনের মামলায় চার্জশিট হয়। সেক্ষেত্রে অন্য ফৌজদারি মামলার সঙ্গে দুদকের মামলার ভিন্নতা রয়েছে। দ্রুত বিচার হলেই দুর্নীতির মামলায় সাজা হওয়ার কথা; কিন্তু নানা কারণে সেটা হচ্ছে না। বিশেষ আইনে করা এ ধরনের মামলার বিচার শেষ করার জন্য আইনে সময় নির্ধারিত রয়েছে।
কিন্তু সেই সময়ের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। মানা হচ্ছে না সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনাও। বিচার শেষ করতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বহুগুণ বেশি সময় লাগছে। এতে মামলার উপাদান, সাক্ষী ও তথ্য-উপাত্ত হারিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘসূত্রতার কারণে সাজার হার কমার পাশাপাশি সাজার কার্যকারিতাও দৃশ্যমান হচ্ছে না। সাজার হার বাড়াতে এবং দুর্নীতি দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে দ্রুত বিচারের বিকল্প নেই বলে আইন বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
২০২২ সালের প্রতিবেদনের সঙ্গে গত বছরের এই প্রতিবেদনের তুলনা করলে দেখা যায়, ২০২৩ সালে দুদকের মামলায় সাজার হার কমেছে প্রায় ৪ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে মোট ৩৪৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। এতে সাজার হার ছিল গড়ে ৬০ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এর মধ্যে কমিশন আমলের মামলায় সাজার হার ছিল ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ। আর ব্যুরো আমলের মামলায় সাজার হার ছিল ৩৫ দশমিক ৯০ শতাংশ।
২০২১ সালে দুর্নীতির মোট ২০৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলা ১৯৩টি। এতে সাজার হার ৬০ দশমিক ১০ শতাংশ। আর ব্যুরো আমলের মামলা নিষ্পত্তি হয় ১০টি। এতে সাজার হার ৩০ শতাংশ। সব মিলিয়ে ২০৩টি মামলা নিষ্পত্তির বিপরীতে সাজার হার ৫৮ দশমিক ৬২ শতাংশ।
একইভাবে ২০২০ সালে দুর্নীতির মোট ১৭৬টি মামলার বিচার হয়। এর মধ্যে কমিশনের মামলা ১৫৫টি। এতে সাজার হার ৭১ দশমিক ৬১ শতাংশ। আর ব্যুরো আমলের মামলা নিষ্পত্তি হয় ২১টি। এতে সাজার হার ৪৭ দশমিক ৬২ শতাংশ। মোট ১৭৬টি মামলা নিষ্পত্তির বিপরীতে গড়ে সাজার হার দাঁড়ায় ৬৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
এ ছাড়া ২০১৯ সালে দুর্নীতির ৩১৭টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। এর মধ্যে কমিশনের মামলা ২৮২টি। এসব মামলায় সাজার হার ছিল ৬৩ শতাংশ। আর ব্যুরো আমলের মামলা নিষ্পত্তি হয় ৩৫টি। এসব মামলায় সাজার হার ৪০ শতাংশ। ২০১৯ সালে মোট ৩১৭টি নিষ্পত্তি হওয়া মামলার বিপরীতে গড়ে সাজার হার ছিল ৬৩ শতাংশ।
সর্বশেষ গত ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, অধস্তন আদালতে দুর্নীতির মোট ৩ হাজার ৩৫৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে কমিশনের দায়ের করা মামলা ২ হাজার ৯৯৪টি এবং বিলুপ্ত ব্যুরো আমলের মামলা ৩৫৯টি। এর মধ্যে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ৪২৬টি মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত আছে। স্থগিত থাকা মামলার মধ্যে ২৪৯টি কমিশন আমলের এবং ১৭৭টি ব্যুরো আমলের।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অধস্তন আদালতে বিচার শেষে মামলা আসে হাইকোর্টে। সাজার বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামিরা। এ ছাড়াও অধস্তন আদালতে বিচার চলাকালে আসামি পক্ষ সময়ক্ষেপণসহ নানা কারণে আসে উচ্চ আদালতে। করেন রিট, ফৌজদারি রিভিশন, ফৌজদারি বিবিধ ও ফৌজদারি আপিল মামলা। উচ্চ আদালতে বিচারের গতি আরও শ্লথ। সাজার হার আরও কম।
কেস স্টাডি-১ : চারদলীয় জোট সরকারের গণপূর্তমন্ত্রী মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের ১৬ আগস্ট রাজধানীর রমনা থানায় মামলা করে দুদক। ২০০৮ সালের ১৬ জুন আদালত এ মামলায় দুদক আইনের ২৬(২) ও ২৭(১) ধারায় অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন। এরপর কেটে গেছে প্রায় দেড় যুগ। এখনো বিচারিক আদালত রায় ঘোষণা করতে পারেনি।
কেস স্টাডি-২ : ২০০৭ সালে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে বিএনপি নেতা সাবেক প্রতিমন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন ও তার ছেলে ব্যারিস্টার মীর হেলাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। বিচার শেষে একই বছরের ৪ জুলাই ঢাকার বিশেষ জজ মীর নাছির উদ্দিনকে ১৩ বছর এবং ছেলে মীর হেলালকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে বাবা-ছেলে হাইকোর্টে পৃথক আপিল করেন। ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর হাইকোর্ট বিচারিক আদালতের রায় বহাল রাখেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে তাদের করা পৃথক লিভ টু আপিল এখনো আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায়।
কেস স্টাডি-৩ : ২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর হাজী মোহাম্মদ সেলিমের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। ২০০৮ সালে বিচারিক আদালত তাকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড এবং ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেন। এরপর ২০২১ সালে হাইকোর্ট ১০ বছর কারাদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। তবে, তিন বছরের দণ্ড থেকে তাকে খালাস দেন। সাজার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করেছেন হাজী সেলিম। তার লিভ টু আপিল এখনো বিচারাধীন।
+ There are no comments
Add yours