সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ পদে জয়ী হয়েছে সরকার সমর্থক আইনজীবীদের প্যানেল। এর আগে দুই দিনের ভোট গ্রহণ পর্ব ছিল সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ। আগের দুটি নির্বাচনের নানা সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে নির্বাচনের সার্বিক আয়োজনও ছিল নিরপেক্ষ।
তার পরও বিতর্কমুক্ত থাকতে পারেনি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের সংগঠনের এই নির্বাচন। ভোট গণনা ও ফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা এই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। শুধু তাই নয়, অনেকের মতে—উচ্চ আদালতের ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত অধ্যায় সৃষ্টি হয়েছে এবার। এ নিয়ে দেশ-বিদেশে চলছে সমালোচনা। এসব কারণে শুধু আদালত অঙ্গন নয়, আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডও ব্রিবত ও চরম ক্ষুব্ধ বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকারের জন্য অস্বস্তিকর এই পরিস্থিতি তৈরির পেছনে যার নাম এসেছে, তিনি সরকার পক্ষেরই আইনজীবী নাহিদ সুলতানা যূথী। পারিবারিক পরিচয়ে তিনি অন্য দশজন আইনজীবীর চেয়ে আলাদা। কারণ এই যূথী যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের স্ত্রী। সমিতির নির্বাচনে সরকার সমর্থকদের আনুষ্ঠানিক প্যানেলের বাইরে সম্পাদক পদে বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন তিনি। ভোট গণনা ও ফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে তার নির্দেশেই সেদিন গভীর রাতে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে। যূথীকে বিজয়ী ঘোষণা করাতে যুবলীগের কিছু নেতাকর্মী জোর করে কেন্দ্রে ঢুকে পড়েন।
এ সময় হামলায় আহত হন একজন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলসহ অন্তত সাতজন আইনজীবী। শুধু তাই নয়, নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধানকে চাপ দিয়ে ভোট গণনার আগেই নাহিদ সুলতানা যূথীকে সম্পাদক পদে বিজয়ী ঘোষণা করতে বাধ্য করা হয়। অ্যাডভোকেট যূথীর এসব কর্মকাণ্ডে বিএনপি-জমায়াত সমর্থক প্রার্থী ও তাদের এজেন্টরা উসকানি দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। একজন দায়িত্বশীল নেতার স্ত্রীর এই ভূমিকায় চটেছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা।
আদালত প্রাঙ্গণে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে কার কী দায়, তা নিয়ে আমি কোনো ব্যক্তিবিশেষের কথা উল্লেখ করতে চাই না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাবনার মেয়ে অ্যাডভোকেট যূথীর স্থানীয়ভাবে তেমন কোনো পরিচিতি নেই। তার বাবা অধ্যাপক আবু সাঈদেরও কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে যূথী রাজধানীতে বসবাস শুরু করেন। দ্বিতীয় বিয়ে করেন দেশের অন্যতম স্বনামধন্য শেখ পরিবারের সন্তান বর্তমানে যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশকে। ‘ক্লিন ইমেজের’ পরশ ২০১৯ সালে যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই আইন অঙ্গনসহ সর্বত্র যূথীর প্রভাব বেড়ে যায়। যুবলীগের কমিটি গঠন, সংগঠন নিয়ন্ত্রণসহ নানা বিষয়ে হস্তক্ষেপ শুরু করেন। ২০২১ সালে পাবনার স্থানীয় রাজনীতিতেও প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেন। পাবনার পৌর নির্বাচনে নৌকার মেয়র প্রার্থী সনি বিশ্বাসের পক্ষে প্রচারণায় নামেন। তবে নির্বাচনে ওই প্রার্থী পরাজিত হন। ফলে এলাকার রাজনীতিতে শক্ত ভিত্তি স্থাপন করতে পারেননি যূথী। এরপর তিনি আর পাবনায় খুব একটা যান না বলে সূত্র জানায়।
পরবর্তী সময়ে যূথী মনোযোগ দেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির দিকে। ২০২২ সালে সমিতির সম্পাদক পদে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন তিনি। কিন্তু সরকার সমর্থক প্যানেলে মনোনয়ন পাননি। এবারও বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের প্যানেল থেকে মনোনয়ন না পেয়ে সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন।
তবে ভোটের দিন থেকেই সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে সাদা শার্টধারী অনেক বহিরাগত ব্যক্তিকে দেখা যায়। তাদের বেশিরভাগই যুবলীগ কর্মী এবং অ্যাডভোকেট যূথীর পক্ষে সমর্থন দিতে তারা সমিতির প্রাঙ্গণে জড়ো হন বলে জানা যায়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেওয়া তথ্য ও ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঘটনার সময় সমিতি মিলনায়তনের ভেতরে ও বাইরে যুবলীগের অন্তত অর্ধশত নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী বশির আহম্মেদ, যুবলীগ নেতা সাইদুর রহমান জুয়েল, জয়দেব নন্দী, মশিউর রহমান সুমন, আসলাম রাইয়ান, ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাইনউদ্দিন রানা, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রেজা, সহসভাপতি সোহরাব হোসেন স্বপন, কামাল উদ্দিন খান, নাজমুল হোসেন টুটুল, মুরসালিন আহমেদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাফর আহমেদ রানা, সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বকুল, মাকসুদুর রহমান, প্রচার সম্পাদক আরমান হক বাবু, অর্থবিষয়ক সম্পাদক ফিরোজ উদ্দিন আহমেদ সাইমন, উপশিক্ষা প্রশিক্ষণ ও পাঠাগারবিষয়ক সম্পাদক আলতাফ হোসেন, ২০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের আহ্বায়ক শেখ সাইদুর রহমান বাবু, যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল হোসেন প্রমুখ।
তারা ভোটকেন্দ্রের ভেতর ঢুকে পড়লে নির্বাচন পরিচালনা-সংক্রান্ত উপকমিটির সদস্য ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এস আর সিদ্দিকী সাইফ পুরো পরিস্থিতির ভিডিও ধারণ করতে থাকেন। এ সময় যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাইদুর রহমান জুয়েল, যুবলীগ নেতা মশিউর রহমান সুমনসহ বেশ কয়েকজন ওই সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের ওপর চড়াও হন। হামরায় তিনিসহ অন্তত সাত আইনজীবী আহত হন। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
চাপ প্রয়োগ করে ফল ঘোষণায় বাধ্য করা সম্পর্কে নির্বাচন পরিচালনা সাবকমিটির প্রধান এক বিবৃতিতে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০২৪-২৫ সালের নির্বাচনে সম্পাদক পদে ফল বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমার নামে প্রচারিত ঘোষণাটি সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন। একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ভোট গণনার আগেই দুঃখজনকভাবে বহিরাগত মাস্তান শ্রেণি দিয়ে আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করে লিখিত দিতে বাধ্য করা হয়।’
ওই রাতে আক্রমণের শিকার হয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুর রহমান (এস আর) চৌধুরী সাইফ তাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে গত শুক্রবার রাতে মামলা করেন। মামলায় নাহিদ সুলতানা যূথী ও ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলসহ ২০ জনের নাম উল্লেখ করে আরও ৩০ থেকে ৪০ জনকে আসামি করা হয়। এ মামলার পাঁচ আসামি আইনজীবী কাজী বশির আহমেদ, তুষার, তরিকুল, এনামুল হক সুমন ও ওসমান চৌধুরীকে শনিবার তিন দিনের রিমান্ডে পায় পুলিশ। এরপর গতকাল ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলকেও রিমান্ডে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়। এখন যূথীসহ অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা জানান, দলীয় শৃঙ্খলার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো ছাড় দেন না। অতীতে তার অনেক নজির রয়েছে। অনেককেই দলীয় পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা যূথীর ক্ষেত্রেও কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলে সূত্র জানায়।
আইনজীবীদের মতে, যূথী শুধু সরকার বা আওয়ামী লীগকেই বিব্রত করেনি, আইনজীবী হিসেবেও অপেশাদার আচরণ করেছেন। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি চাইলে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারে।
জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির প্রধান অ্যাডভোকেট আবুল খায়ের বলেন, ‘সেদিন যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে কেউ অভিযোগ দিলে অথবা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বার কাউন্সিল ও সমিতি পদক্ষেপ নিতে পারে। শৃঙ্খলার বাইরে কাজ করলে বার কাউন্সিল সনদ বাতিল করতে পারে। সমিতি পেশাগত দায়িত্ব থেকে বিরত রাখতে পারে।’
+ There are no comments
Add yours