বাবার চাকরির সুবাদে সরকারি কলোনীতেই বেড়ে ওঠা। কলোনীর ভেতরেই ছিল স্কুল। প্রতিবছর ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে স্কুলের শহিদ মিনারে ফুল দেওয়ার জন্য পাড়ার কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ধুম লেগে যেত। ভোরবেলা মক্তবে পড়া শেষ করেই সবাই ছুট লাগাত ফুল কুড়াতে। ফুলেরও অভাব ছিল না। মক্তব থেকে ফেরার পথেই বড় শিউলি ফুলের গাছ পড়ত,যার নিচে ভোরবেলাতেই ফুলে ফুলে ছেয়ে যেত।
এছাড়া কলোনীতেই দুটো বড় বড় নার্সারি ছিল,যেখানে সে কিশোর-কিশোরীদের ছিল অবাধ বিচরণ, বলা-বাহুল্য সে দলে আমিও ছিলাম।
কাঠগোলাপ,শিউলি,গাঁদাসহ নাম না জানা শত ফুলের সমাহার ছিল সেসব নার্সারিতে। ভোরবেলাতেই তাই আমরা কোচড় ভরে ফুল সংগ্রহ করতাম।ফুলসংগ্রহ হলে দলবেঁধে সে ফুলগুলো নিয়ে চলে যেতাম স্কুল প্রাঙ্গনে।
সে সময় নিজের টাকায় ফুল কেনা হত না,কলোনীর ভেতরেই স্কুল তাই টিফিন টাইমে বাসায় এসে ভাত খেয়ে আবার স্কুলে দৌড় লাগাতাম। টিফিনের জন্য তাই স্বাভাবিকভাবেই আব্বা ধরাবাঁধা টাকা দিতেন না। তবে মাঝে মধ্যে চকলেট ,আইস্ক্রিম খাওয়ার জন্য একটাকা, দুই টাকা দিতেন। সেগুলোই জমিয়ে জমিয়ে সে বয়সী সাধ (আইস্ক্রিম,আচার,চকলেট খাওয়ার) পূরণ করতাম। ফ্রেব্রুয়ারি মাস এলেই কিছু টাকা জমিয়ে রাখতাম। কলোনীর মোড় থেকে তাজা গোলাপ কিনে শহিদ মিনারে দেব বলে।
স্কুলেই বিশাল বাগান ছিল। বয়সে ছোট হওয়ার কারণে সে বাগান থেকে ফুল নেওয়ার অনুমতি ছিল না,পাছে ফুল নিতে গিয়ে অন্য সব গাছ মাড়িয়ে দিই যদি! কিন্তু প্রতিবছরই শহিদ মিনারে ফুল দেওয়ার প্রতি আমাদের আগ্রহ দেখে একটা সময় স্কুল থেকেই অনুমতি দিল ফুল সংগ্রহের। সে সময়ের পর স্কুলের বাগান থেকেও ফুল নিয়ে সেগুলো শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে অর্পন করতাম। গুনগুন করে গেয়ে উঠতাম আমরা “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,আমি কি ভুলিতে পারি….”
শহিদ মিনারে ফুল দেবার জন্য যতবারই খালি পায়ে উঠেছি… কী এক রোমাঞ্চ হত… তখন বুঝতাম না হয়তো… এখন বুঝি… ভাষার জন্য একটা জাতি প্রাণ দিয়েছে,রক্তে রঞ্জিত করেছে রাজপথ… এ বোধটা খুব করে নাড়া দিত… এখনও সেই বোধ কাজ করে।
কী অসীম ভালবাসা থেকে এতটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারে একটা জাতি!
ভাষার মাসে সকল শহিদদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
+ There are no comments
Add yours