
দেশে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মোট সংখ্যা ৫৮। এরপর পর্যায়ক্রমে অধিদপ্তর ও অন্যান্য দপ্তর বা সংস্থা আছে ৩৫৩টি। দেশের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন প্রশাসন ক্যাডারের প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কর্মকর্তা। তবে চাকরি ক্ষেত্রে তাদের সবাই সমানভাবে মূল্যায়িত হন না। নানা বিবেচনায় প্রভাবশালীরা তুলনামূলক গুরুত্বপূর্ণ ও অধিকতর সুবিধাসম্পন্ন দপ্তরগুলোতে ঘুরেফিরে দায়িত্ব পান। আর যোগ্যতা ও দক্ষতায় এগিয়ে থাকলেও শুধু দাপট দেখাতে না পারায় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় বা বিভাগে চেয়ার পান না অনেক কর্মকর্তা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কয়েকশ প্রজ্ঞাপন পর্যালোচনা এবং বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে প্রশাসনে বদলি ও পদায়নে চরম বৈষম্যের এ চিত্র পাওয়া গেছে। সরকারের সব দপ্তরে সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা ছাড়া বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রশাসনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, স্বরাষ্ট্র এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কিংবা স্থানীয় সরকার বিভাগের দিকেই ছুটতে চান বেশিরভাগ কর্মকর্তা। এ ক্ষেত্রে ব্যাচভিত্তিক সংগঠনের নেতারা এগিয়ে থাকেন। তারা চাইলেই বড় মন্ত্রণালয়ে পদায়ন নিয়ে বছরের পর বছর সেখানে বসে থাকছেন। আবার আরেক শ্রেণির বড় কর্মকর্তা অর্থাৎ সচিব কিংবা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের সঙ্গে সখ্য গড়েও পছন্দমতো পদায়ন বাগিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু যারা উচ্চ পর্যায়ে ঘনিষ্ঠতা রক্ষা করতে পারেন না, আবার ব্যাচের নেতৃত্বেও নেই, তারা সব সময় পিছিয়ে থাকেন। চাইলেই তারা পছন্দমতো পদায়ন পাচ্ছেন না। ফলে একাডেমিক যোগ্যতা ও কর্মক্ষেত্রের দক্ষতায় এগিয়ে থাকলেও তারা সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকা মন্ত্রণালয় বা বিভাগে পদায়ন পান না। এতে তাদের মধ্যে এক ধরনের হীনম্মন্যতা ও হতাশা কাজ করে। কর্মকর্তারা জানান, ছোট মন্ত্রণালয় ও বিভাগে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা যেতে চান না। এসব দপ্তরে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারাই বেশি। মুক্তিযুদ্ধ, সমাজকল্যাণ, সংস্কৃতি, মহিলা ও শিশু, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ, খাদ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম কিংবা ধর্ম মন্ত্রণালয়ে তুলনামূলক নিরীহ কর্মকর্তারা কাজ করছেন। প্রশাসনে তাদের দাপট কম। এসব মন্ত্রণালয়ে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ কম। প্রাধিকার গাড়ি সুবিধার বাইরে মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা গাড়ির সুবিধাও নেই। ফলে কর্মকর্তারা এসব মন্ত্রণালয় এড়িয়ে চলতে চান। যারা এসব মন্ত্রণালয় আছেন, তারাও বদলি হতে মরিয়া।
অন্যদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ, স্বরাষ্ট্র, অর্থ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে। এর বাইরেও আছে নানা সুবিধা। এসব মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রাধিকার গাড়ি সুবিধা পাওয়ার পরও মন্ত্রণালয়ের অধীন অধিদপ্তর বা সংস্থা থেকে বাড়তি গাড়ি ব্যবহার করেন। এসব গাড়ির ড্রাইভারের বেতন ও তেল খরচ সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা সংস্থা বহন করে। এ ছাড়া দপ্তর বা সংস্থার সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ করলে রয়েছে নগদ সম্মানীর ব্যবস্থা।
সূত্র জানায়, কৃষি, শিক্ষা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ, নৌপরিবহন, বেসামরিক ও বিমান পরিবহন, বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে মাঝারি মানের মন্ত্রণালয় ধরা হয়। এসব মন্ত্রণালয় থেকে বিদেশ ভ্রমণ কিংবা আর্থিক সুযোগ-সুবিধা খুব বেশি মেলে না। তবে যারা নিজেদের পদোন্নতি নিশ্চিত করতে চান, তারা জনপ্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পদায়ন নিতে উন্মুখ থাকেন। এই দুই দপ্তরে তুলনামূলক স্বচ্ছ ইমেজের কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হয় বলে প্রশাসনে প্রচলিত ধারণা রয়েছে। তবে এই কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক বলে ধরে নেওয়া হয়। ফলে জনপ্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্মকর্তাদের অন্যতম পছন্দের জায়গা।
 
 
 
সার্বিক এ পরিস্থিতি সম্পর্কে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আসলে কোনো মন্ত্রণালয়-বিভাগই ছোট নয়। সবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে কিছু কিছু মন্ত্রণালয়ে তুলনামূলক
সুযোগ-সুবিধা কম। বিদেশ ভ্রমণ নেই। প্রশাসনের সব জায়গায় সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সমতা আনতে পারলে কর্মকর্তারা যে কোনো দপ্তরে দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত হবেন।’
বড় দপ্তর ছাড়তে নারাজ প্রভাবশালীরা:
কর্মচারীদের সঙ্গে খারাপ আচরণের অভিযোগ ওঠার পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দা সালমা জাফরিনকে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। গত ১০ মার্চ এ-সংক্রান্ত আদেশ জারি হলেও এখন পর্যন্ত তিনি তথ্য মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেননি। গুঞ্জন রয়েছে, তিনজন মন্ত্রী ও সাবেক একজন মন্ত্রিপরিষদ সচিব তার বদলি বাতিলের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রী ও সচিবের কাছে সুপারিশ করেছেন। এজন্য সালমা জাফরিন এখনো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ছাড়ছেন না।
শুধু জাফরিনই নন, আরও বেশ কয়েকজন ‘প্রভাবশালী’ কর্মকর্তাকে বদলি করা হলেও তারা নতুন কর্মস্থলে যেতে অনীহা দেখাচ্ছেন। বদলি বাতিলের জন্য তদবিরে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। অবশ্য দু-একজন শেষ পর্যন্ত নতুন কর্মস্থলে যোগদান করতে বাধ্য হয়েছেন।
বদলির পর প্রভাব খাটিয়ে আদেশ বাতিলের মাধ্যমে প্রশাসন শৃঙ্খলা হারাচ্ছে কি না—এমন প্রশ্নে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘বদলি আমাদের প্রশাসনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বদলি করা হলে নতুন কর্মস্থলে যেতে হবে—এটাই নিয়ম। এটা সর্বাত্মকভাবে অনুসরণ করা হবে—এটাই প্রত্যাশা। এটি আমরা সবসময় অনুসরণও করি। কখনো কখনো ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনা ঘটে।’
মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরও বলেন, ‘কেউ যদি উদ্দেশ্যমূলকভাবে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বদলি ঠেকানোর চেষ্টা করেন, সেটি হলো গর্হিত কাজ। অনেক সময় আমার নিজের চাকরিজীবনে দেখেছি, বদলি করেছেন কিন্তু সেখানকার যে কর্মকর্তা, তিনি হয়তো মনে করছেন আরও কিছুদিন আমাদের সঙ্গে থাকুক, তার সার্ভিস ভালো। ভালো-খারাপ দুটোই হতে পারে। তারা আরও কিছুদিন রাখতে চান। এটি কিন্তু আমাদের প্রশাসনিক কার্টেসির একটি অংশ। যখন সিনিয়র অফিসার চান, তখন আমরা কিছুদিন রেখে দিই। কিন্তু এটা এই নয় যে, তাকে বদলি করা যাবে না। বদলি অবশ্যই তাকে করতে হবে; তিনি তো স্থায়ী থাকতে পারেন না।’
                                            
                                            
                                            
                                            
                                            
                                            
                                            
                                            
                                            
                        
                
                                    
                                    
                                    
                            
                            
                            
                                                        
                                
                        
                                                
                                                
                                                
                                                
                                                
                                                
                                                
                                                
+ There are no comments
Add yours