২০১৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অকথ্য নির্যাতনে শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের মৃত্যু ঘটে। ওই ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ক্যাম্পাসটিতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বুয়েট কর্তৃপক্ষ।
সেই থেকে দীর্ঘদিন বুয়েট ক্যাম্পাসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনগুলোর কার্যক্রম অনেকটা স্থবির ছিল। যদিও গত ১ এপ্রিল বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া ২০১৯ সালের আদেশ স্থগিত করেন হাইকোর্ট। এরপর থেকে বুয়েটে ধীরে ধীরে সরব হতে শুরু করেছে ছাত্রসংগঠনগুলো।
অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের মতো বুয়েটে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরও সরব হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তাদের দাবি, ইতোমধ্যে বুয়েট শাখার বেশ কয়েকটি কমিটি গঠন করেছে শিবির। সবকিছু গোপনে করে আসছে ছাত্রসংগঠনটি।
বুয়েট শাখা শিবিরের কয়েকটি কমিটির নাম সম্বলিত ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রচারিত হচ্ছে। চাঞ্চল্যকর বিষয় হলো, শিবিরের কমিটিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ছাত্রলীগের অনেক সমর্থকেরও নাম দেখা গেছে। শিবিরের গঠন করা চারটি কমিটিতে দু-একজনের নামের মিল পাওয়া গেছে। এ ছাড়া, আলাদা কমিটিতে একজনকে আলাদা পদেও রাখা হয়েছে।
ফেসবুকের নিউজফিডে ভেসে বেড়ানো শিবিরের একটি কমিটির লিস্টে দেখা যায়, সেখানে মোট সদস্য রয়েছেন ১১ জন। কমিটির সদস্যদের নাম এবং দায়িত্বের পাশাপাশি শাখার নাম ও শপথের তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। ওই কমিটিতে সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন বুয়েটের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ফাদেল ফারুক অমিয়। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আছেন খন্দকার জাহিন। এ ছাড়া, অফিস সম্পাদক হিসেবে সাফাত হোসাইন মুগ্ধ, বায়তুলমাল সম্পাদক হিসেবে নূর ইসলাম অন্তর, থানা সভাপতি হিসেবে আব্দুল্লাহ আল মুকিত ও মামুন আকন, সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে আল ফারাবি, তথ্য সম্পাদক হিসেবে তানভীর মাহমুদ স্বপ্নীল, ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে তানভীরুল ইসলাম সাজিন, সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক হিসেবে আল ফাত্তাহ সিদ্দিক ওহি, কোচিং পরিচালক হিসেবে তৌফিক হায়দার রচি ও উপ-প্রকাশনা সম্পাদক হিসেবে রয়েছেন শাহরিয়ার হাসান।
শিবিরের ওই কমিটিতে কেমিক্যাল ২০ ব্যাচের শিক্ষার্থী আশিক আলমকে ছাত্র আন্দোলন সম্পাদক এবং সিভিল ২০ ব্যাচের শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ স্বপ্নীলকে তথ্য সম্পাদক পদ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি ফেরানোর লক্ষ্যে ছাত্রলীগের সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন এ দুজন। ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের কাছে তারা ছাত্রলীগের সমর্থনকারী হিসেবে পরিচিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, শিবির প্রচারণা চালাচ্ছে। তাদের কমিটি এখানে আছে কি না, আমরা জানি না। তবে, সম্প্রতি তিন-চারটি কমিটির তালিকা আমাদের সামনে ঘুরছে। কোনটি সত্য আর কোনটি বানোয়াট, জানি না। নাকি সবগুলোই গুজব, বলতে পারছি না। শিবিরের কমিটি থাকলে এতগুলো কেন? আবার তাদের নেতৃত্বও আলাদা। কেউ এক কমিটিতে সভাপতি… আবার অন্য কমিটির সেক্রেটারি। আবার অন্যগুলোতে তাদের নামও নেই। প্রশাসনের উচিত বিষয়টির তদন্ত করা। ক্যাম্পাসে সত্যিই শিবিরের কার্যক্রম রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা। বুয়েট ছাত্ররাজনীতি মুক্ত থাকবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
ইইই ২০ ব্যাচের এক শিক্ষার্থী বলেন, মনে হচ্ছে পুরো বিষয়টি গুজব। তা না হলে একটি দলের মাত্র ১১ জনের কমিটি থাকবে? আবার পৃথক চারটি কমিটি, এক কমিটির সঙ্গে অন্যটির মিল নেই। বুয়েটে শিবিরের কার্যক্রম রয়েছে— এমনটি সবাই বলে থাকে, বিষয়টি সবার মুখে মুখে। তবে, এর প্রমাণ আমাদের কাছে নেই।
এদিকে, কয়েক মাস আগে বুয়েট ক্যাম্পাসে শিবিরের সক্রিয়তার বিষয়ে জানিয়েছিলেন জামায়াতের ঢাকা দক্ষিণ শাখার সেক্রেটারি ও কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ। গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শিবিরের সাবেক এ সভাপতি বলেন, বুয়েট হলো বেশিরভাগ মেধাবী শিক্ষার্থীর জায়গা। তাই আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ক্যাম্পাসে কাজ করছি। বুয়েটের ছাত্র ছাড়া শিবিরের মতো সংগঠন কীভাবে চালানো যায়?
এ ছাড়া, গত বছরের জুনে প্রত্যন্ত এক হাওর এলাকায় নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের ষড়যন্ত্র করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন শিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২৪ বুয়েট শিক্ষার্থী। অবশ্য, বর্তমানে তারা জামিনে রয়েছেন। এমনকি ক্লাস ও পরীক্ষায় নিয়মিত অংশগ্রহণও করছেন তারা।
অন্যদিকে, নিষেধাজ্ঞা থাকাকালে গত ২৮ মার্চ মধ্যরাতে বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও দপ্তর সম্পাদকসহ অন্য নেতাকর্মীরা। বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রবেশের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বুয়েট শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ রাব্বি। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পর বুয়েটে এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে নতুন করে ‘রাজনীতি শুরুর পাঁয়তারা’ হিসেবে দেখছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। যার পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাম্পাসে পুনরায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু এবং সার্বিক নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে আন্দোলন শুরু করেন তারা। ফলে টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা বর্জন করেন বুয়েটের সব ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দেন। একপর্যায়ে ‘দাবি মেনে নিতে হবে ও পরীক্ষা পুনরায় নিতে হবে’— এমন শর্তে ক্লাসে ফেরেন বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
তবে, বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি ফেরাতে এবং ক্লাস-পরীক্ষা নিয়মিত চলমান রাখতে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করেন গুটিকয়েক শিক্ষার্থী। এমনকি সবাই যখন ক্লাস-পরীক্ষা বয়কট করেন, সেসময়ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন তাদের কয়েকজন। ফলে ছাত্রলীগের সমর্থক হওয়ায় তাদের বয়কট করেন বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এরপর সাধারণ শিক্ষার্থীদের ফেসবুক গ্রুপ থেকেও তাদের সাসপেন্ড করা হয়। পাশাপাশি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের প্রবেশের কারণে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে বুয়েটের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সংবাদ সম্মেলন করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
এদিকে, শিবিরের কমিটিতে নাম থাকা ছাত্রলীগ সমর্থকদের দাবি, যেহেতু কয়েক দিন ধরে শিবিরের কমিটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তাই বিষয়টি ধামাচাপা দিতে বাকি কমিটিগুলোর লিস্ট ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে শিবিরের সেসব কমিটির লিস্টে ছাত্রলীগের সমর্থকদের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
+ There are no comments
Add yours