২০২২ সালের জুলাই মাসে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি বড় গণআন্দোলন প্রত্যক্ষ করে। প্রাথমিকভাবে এটি কোটা সংস্কার নামে পরিচিতি পেলেও দ্রুতই এটি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শাসনের বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর সরকারবিরোধী গণআন্দোলনে পরিণত হয়। সমগ্র জুলাই মাস জুড়েই চলে এই আন্দোলন। আগস্ট মাসের গোড়ার দিকে ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেন। এরপর নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের ফলে রাজনীতিতে তাৎক্ষণিক দুটো বিষয় পরিলক্ষিত হয়। একটি হলো, রাজনৈতিক ক্ষমতার শূন্যতা এবং অপরটি হলো বাংলাদেশের একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগের পতন। অন্যদিকে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এই পরিস্থিতিকে নিজেদের পুনরুত্থানের একটা সুযোগ হিসেবে দেখছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে, পদ্ধতিগত সংস্কারের পক্ষে বিশেষ দাবি উঠেছে। ড. ইউনূসের অধীনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এই জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশ পরিচালনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিবিড়ভাবে বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিবেশ প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করছে।
আওয়ামী লীগ নতুন নেতৃত্বের অধীনে পুনরায় সংগঠিত হয়ে নিজেদের ভুল গুলো সংশোধন করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে তাদেরকে অবশ্যই জনসাধারণের অভিযোগগুলি আমলে নিতে হবে। এজন্য শক্তিশালী নেতৃত্ব এবং উল্লেখযোগ্য অভ্যন্তরীণ সংস্কারের বিকল্প এখন আওয়ামী লীগের আছে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের একটি পুরোনো দল হিসেবে তাদের যথেষ্ট সমর্থন এখনও জনগনের মধ্যে আছে বলে ধরে নিচ্ছি। আওয়ামী লীগকে অবশ্যই এই সমর্থনকে কাজে লাগাতে হবে। তবে এরকম একটা পরিস্থিতিতে খুব সহজেই যে আওয়ামী লীগ এই সমর্থনকে কাজে লাগাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। এজন্য অবশ্যই আওয়ামী লীগকে সময় দিতে হবে। তবে সবচেয়ে জরুরি নিজেদের ভুলগুলোকে জনগনের কাছে স্বীকার করে নেওয়া এবং নতুন নেতৃত্বকে সামনে নিয়ে আসা। এক্ষেত্রে তাদেরকে আরও একটা বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করি। সেটা হলো, কৌশলগত যোগাযোগ (strategic communications)। আওয়ামী লীগের মতো একটি বৃহৎ দলের কোনো structured strategic communications mechanism নেই সেটা ঠিক মানা যায় না।
কার্যকর নতুন নেতৃত্ব ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ বিভাজনের ঝুঁকিতে রয়েছে। এরকম একটা সময়ে আওয়ামী লীগ আশা করি তাদের পুরোনো অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাবে। তবে যদি আওয়ামী লীগ নিজেদের গুছিয়ে নিতে এবং নিজেদের ভুলগুলোকে অনুধাবন করতে না পারে, তবে বৃহৎ এই দলটি দীর্ঘ সময়ের জন্য প্রান্তিক দলে পরিণত হতে পারে। আমরা যদি ভারসাম্যের রাজনীতির কথা বলি তাহলে এটা কোনদিনই কাম্য নয়।
এদিকে বর্তমান পরিস্থিতি বিএনপির জন্য একটি বড় সুযোগ, যদি তারা এটিকে কাজে লাগাতে পারে। বিরোধীদের একত্রিত করে এবং একটি স্পষ্ট সংস্কারের এজেন্ডা উপস্থাপন করে বর্তমান ক্ষমতার শূন্যতা দখল করতে পারে বিএনপি। তবে, এজন্য অভ্যন্তরীণ বিভাজনগুলো কাটিয়ে ওঠা এবং কার্যকরভাবে জনসাধারণের সমর্থন সংগঠিত করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এখানেও বিএনপি’কে মনে রাখতে হবে, এরুপ একটি সময়ে জোড় খাটিয়ে কিছু আদায় করা যাবে না। তাদেরকে ধৈর্য ধরতে হবে এবং তাদের করা আগের ভুলগুলো থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বিএনপি’তে নেতৃতের সংকট খুবই পরিস্কার যা তাদের দ্রুতই কাটিয়ে উঠতে হবে।
যদি বিএনপি এই পরিস্থিতিকে পুঁজি করতে এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজন মিটিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তারা আরও দীর্ঘ সময় প্রান্তিক দল হয়ে থেকে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। যার ফলে অন্যান্য শক্তি বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক শূন্যতাকে কাজে লাগিয়ে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে।
বর্তমান আন্দোলন পদ্ধতিগত সংস্কার এবং স্বচ্ছতার পক্ষে একটি জোট গঠন করতে পারে, যা সম্ভাব্যভাবে আরও গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম । এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে বর্তমানে চলমান আন্দোলনে এখন পর্যন্ত দেশের সাধারন মানুষের একটা বড় সমর্থন রয়েছে। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে খুব সহজেই একটি জোট গঠন করে তা কার্যকরীভাবে পরিচালনা করা খুব একটা সহজ না। তবে যাই হোক, এরুপ সম্ভাবনাকে বর্তমান পরিস্থিতিতে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যদিও নতুন জোট গঠন হলেও তাদের পথচলা খুব সহজ হবে না বরং তাদেরকেও যথেষ্ট প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হবে।
“দেখা যাক এই সংহতি কতদিনের” – এমন একটা কথা ইদানিং শোনা যাচ্ছে। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যদি কোনো নতুন দল প্রতিষ্ঠিত হয়, সংহতি হবে তার একমাত্র হাতিয়ার। এই সংহতিকে টিকিয়ে রাখা এবং সঠিক পথে দীর্ঘ সময় পরিচালিত করা নতুন প্রতিষ্ঠিত দলগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, যার ফলে তাদের প্রান্তিক-করণ হতে পারে।
এদিকে ড. মুহম্মদ ইউনূস ক্ষুদ্রঋণ এবং দারিদ্র্য বিমোচনে তার কাজের জন্য পরিচিত। রাজনৈতিক কিছু বিবাদ ও শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও ড. মুহম্মদ ইউনূসের একটি সাধারণ গ্রহণযোগ্যতা আছে যা বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি স্থিতিশীল প্রভাব আপাতদৃষ্টিতে রাখতে পারে। তার আন্তর্জাতিক খ্যাতিও এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী সমর্থন আকর্ষণ করতে পারে, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষা করতে পারে বলে আশা করা যায়।
এদিকে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ড. ইউনূস বেশকিছু উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন। তাকে অবশ্যই একটি গভীর মেরুকৃত রাজনৈতিক দৃশ্যপটের মধ্য দিয়ে দেশ পরিচালনা করতে হবে যেখানে আরও যুক্ত থাকবে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং মানবাধিকারের উদ্বেগ। তার সাফল্য নির্ভর করবে একটি স্থিতিশীল সরকারে শান্তিপূর্ণ স্থানান্তর নিশ্চিত করার পাশাপাশি এই দাবিগুলোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার ওপর।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং ড. মুহম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। এই পরিবর্তন কেবল অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই নয়, বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলবে। নেতৃত্বের পরিবর্তন এমন এক সময়ে এসেছে যখন বিশ্ব শক্তিগুলো দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যাচ্ছে ভারত। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশকে একটি কৌশলগত অংশীদার হিসেবে দেখে থাকে, শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখে। শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ভারতের পক্ষে অনুকূল ছিল বেশকিছু কারণেই, যার বিস্তারিত আলোচনায় এখানে গেলাম না।
নতুন নেতৃত্ব কীভাবে অভিবাসন ও সন্ত্রাসবাদের মতো বিষয়গুলি মোকাবিলা করবে, যা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক, তা ভারত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে বলেই মনে হচ্ছে। বাংলাদেশের যেকোনো অস্থিতিশীলতা ভারতের ওপর, বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে সেটা আমরা খুব সাভাবিক ভাবেই বলতে পারি। তবে এটি আশাকরি কারো জন্যই কাম্য না।
পরবর্তীতে আরও লিখা চলমান থাকবে…..।
লেখক মোঃ মাহবুবুল আলম সহযোগী সম্পাদক
জাতীয় দৈনিক স্বদেশ বিচিত্রা
+ There are no comments
Add yours