
সৌদিসহ আরব দেশগুলো কীভাবে ইসরায়েলকে সহায়তা করছে?
ডেস্ক নিউজ:
ইসরায়েলের আশপাশের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে ইহুদিবাদি সরকারের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে উত্তেজনাপূর্ণ হলেও, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং পরোক্ষ সামরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই সম্পর্কে নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। আব্রাহাম চুক্তি থেকে শুরু করে গোপন কৌশলগত সমঝোতা—কিছু আরব দেশ ইসরায়েলকে বিভিন্নভাবে সুবিধা দিচ্ছে, যা আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে তেল আবিবকে শক্তিশালী করেছে। এই প্রতিবেদনে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এই জটিল সম্পর্কের চিত্র তুলে ধরা হলো:
ইসরায়েলের সঙ্গে কিছু আরব দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক গত এক দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ২০২৪ সালে ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।
আরব আমিরাতের একটি সরকারি প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ইসরায়েলি অস্ত্র প্রস্তুতকারী কোম্পানি থার্ডআই সিস্টেমসে ১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে, যা ইসরায়েলের সামরিক শিল্পকে শক্তিশালী করছে।
একইভাবে, জর্ডান ১৯৯৪ সালের শান্তি চুক্তির পর থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে কৃষিজাত পণ্য ও পানি সম্পদ ভাগাভাগির মাধ্যমে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
মিশরও ১৯৭৯ সালের ‘ক্যাম্প ডেভিড’ চুক্তির পর থেকে ইসরায়েলে প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি করছে। ২০২৪ সালে মিশর থেকে ইসরায়েলে গ্যাস রপ্তানি ১২% বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ইসরায়েলের জ্বালানি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
এই অর্থনৈতিক সহযোগিতা ইসরায়েলের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে এবং প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা খাতে অগ্রগতিতে সহায়তা করছে।
রাজনৈতিক সমঝোতা: কূটনীতির পর্দার আড়ালে
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, কিছু আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে প্রকাশ্য বা গোপন সমঝোতায় এসেছে। সৌদি আরব আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি না দিলেও, ইরানের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ শত্রুতার কারণে ইসরায়েলের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের খবর পাওয়া যায়।
২০২৪ সালে ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিহত করতে সৌদি আকাশসীমা ইসরায়েলি ও মার্কিন বিমানের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল বলে বিভিন্ন সূত্র গণমাধ্যমে জানিয়েছে।
জর্ডান ও মিশর ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলকে আঞ্চলিক সুবিধা দিয়ে রেখেছে। জর্ডান ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের নিয়ন্ত্রণে ইসরায়েলের সঙ্গে মিলেমিশে সমন্বয় করে, যা ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক।
বাহরাইন ও মরক্কোও আব্রাহাম চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে, যা ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা কমিয়েছে। এটি ইসরায়েলকে আঞ্চলিকভাবে ‘নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকা’ বজায় রাখতে সহায়তা করে।
সামরিক সুবিধা: বন্দর, আকাশসীমা ও মার্কিন ঘাঁটি
ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহে আরব দেশগুলোর ভূখণ্ড ও সুবিধা ব্যবহারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এটি প্রায়শই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ঘটে। মূলত আরব দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে জনমত দমনের ফলে সেখানে শাসকরা গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ও সমঝোতা গোপনে রাখে, তাই অভিযোগগুলো উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
২০২৪ সালে ইরানি হামলা প্রতিরোধে জর্ডান ও সৌদি আরবের আকাশসীমা ব্যবহার করেছিল ইসরায়েল। এটি ইসরায়েলকে নিজেদের প্রতিরক্ষায় পরোক্ষ সহযোগিতা দিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো, যেমন সৌদি আরবের প্রিন্স সুলতান এয়ার বেস এবং কাতারের আল-উদেইদ এয়ার বেস, অস্ত্র সংরক্ষণ ও সরবরাহের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। বিশ্লেষকদের মতে, এসব ঘাঁটি থেকে ইসরায়েলে অস্ত্র পাঠানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
তুরস্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশ, গাজা যুদ্ধের মধ্যেও ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছে। কিছু প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, তুরস্কের বন্দর দিয়ে ইসরায়েলে পণ্য ও সম্ভাব্য সামরিক সরঞ্জাম পাঠানো হয়েছে।
কৌশলগত স্বার্থ: ইরানের বিরোধিতা
ইরানের বিরুদ্ধে সৌদি আরব, আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের মতো দেশগুলোর যে অবস্থান, সেটি ইসরায়েলের সঙ্গে আরব শাসকদের স্বার্থের মিল ঘটিয়েছে। এই দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে গোপন গোয়েন্দা সহযোগিতা করে, যা ইসরায়েলের আঞ্চলিক প্রভাব বৃদ্ধিতে সহায়ক।
জর্ডান ও মিশর সংঘাত এড়িয়ে নিজেদের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর জোর দিচ্ছে, যা ইসরায়েলকে আঞ্চলিক শক্তিশালী অবস্থানে রাখতে সহায়তা করে।
জনমতের বিপরীতে সরকারি নীতি
ইসরায়েলকে এতো সহযোগিতা সত্ত্বেও, আরব দেশগুলোর জনগণের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি বিরোধী মনোভাব প্রবল। সরকারগুলো জনগণের সমালোচনা এড়াতে সম্পর্কের বিষয়গুলো গোপন রাখে বা ফিলিস্তিনি ইস্যুতে ‘প্রতীকী সমর্থন’ দেখানোর চেষ্টা করে। তবে, বাস্তবে তাদের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দিকে ঝুঁকছে।
বিশেষজ্ঞদের মত, বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এসব সহযোগিতা ইসরায়েলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা হিসেবে কাজ করছে। আশপাশের মুসলিম দেশগুলো অর্থনৈতিক সহযোগিতা, রাজনৈতিক সমঝোতা এবং পরোক্ষ সামরিক সুবিধার মাধ্যমে ইসরায়েলকে শক্তিশালী করছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতা এবং আঞ্চলিক কৌশলগত সমীকরণ এই সম্পর্কের মূল চালিকাশক্তি। যদিও ফিলিস্তিন ইস্যুতে ঐতিহাসিক আরব অবস্থানের সঙ্গে এটি সাংঘর্ষিক।
সূত্র: ইত্তেফাক
+ There are no comments
Add yours