মোঃ রায়হান আলী
আজকাল সমাজে হরহামেশাই আমারা শুনতে পাই কোর্ট ম্যারেজের কথা। ইংরেজী Misnomer শব্দের অর্থ হল ভুল অর্থে শব্দের প্রয়োগ। আর প্রকৃতপক্ষে এই কোর্ট ম্যারেজ শব্দটিও ভুল অর্থে সমাজে প্রচলিত শব্দ। কোর্ট ম্যারেজ বলতে যে বিয়ে প্রচলিত সেটা ধর্মীয় মতে বৈধ নয় এবং এর আইনগত ভিত্তি ও বৈধতা কিছুই নেই। এটি একটি লোকমুখে প্রচলিত শব্দ মাত্র।
প্রচলিত অর্থে কোর্ট ম্যারেজ বলতে সাধারণত হলফনামার মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিয়ের ঘোষণা দেওয়াকেই বোঝানো হয়ে থাকে। এ হলফনামাটি ২০০ টাকার ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লিখে নোটারি পাবলিক কিংবা প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে মুসলিম বিয়ের ক্ষেত্রে “The Muslim Family Laws Ordinance, 1961 এর বিধিবিধান মানা হয় যা একটি শরীয়াভিত্তিক আইন। যেহেতু আমাদের দেশ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ তাই ধর্মীয় অনুশাসন বা বিধি-বিধান মেনে আইনগত ভাবে বিয়ে করলে সে বিয়ে বৈধ বলে বিবেচিত হবে।
সাধারনত বর-কনে যে অঞ্চলে বসবাস করে সে অঞ্চলের নিকাহ্ রেজিষ্ট্রার দ্বারা বিয়ে সম্পন্ন করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। কিন্তু বর কনে চাইলে নিজের ইচ্ছা ও সুবিধা মত দেশের যে কোন স্থানের নিকাহ্ রেজিষ্ট্রার দ্বারা নিকাহ্ বা বিয়ে সম্পন্ন করতে পারে। সেক্ষেত্রে মুসলিম আইন অনুযারী বর-কনে উভয়ের পক্ষ থেকেই দু’জন পুরুষ এবং একজন নারীর উপস্থিত সাক্ষী হিসেবে থাকা বাধ্যতামূলক।
The muslim marriages and divorces(Registration)Act,1974 অনুযায়ী প্রতিটি বিবাহ নিবন্ধন করতে হবে। এটাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যে বিয়েতে স্বয়ং নিকাহ রেজিষ্টার বা কাজীর মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হয় সে ক্ষেত্রে উক্ত বিয়েতে অবশ্যই তৎক্ষণাৎ বিয়েটি রেজিষ্ট্রি করতে হবে। বিবাহের দিন বা কোন কারণে বিবাহটি রেজিষ্ট্রি করা সম্ভব না হলে,ধরে নেয়া যাক;একজন নিকাহ রেজিষ্ট্রার ব্যতিত অন্য কেউ যেমন কোনো মাওলানা বা হুজুরের মাধ্যমে বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে বিয়ে যেদিন হবে সেদিন থেকে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট নিকাহ্ রেজিষ্ট্রারের কাছে গিয়ে বিয়ে নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে। আর এই নিয়ম অমান্যকারীদের জন্য রয়েছে শাস্তির বিধান। মুসলিম আইন অনুযায়ী বিবাহ নিবন্ধন না করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এমন অপরাধীর বিচারক্রমে ২ বৎসর বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ৩০০০ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড প্রযোজ্য হতে পারে। প্রচলিত ‘কোর্ট ম্যারেজ’ খ্যাত হলফনামার শর্তাবলীতেও লেখা থাকে পরবর্তীতে বিবাহ নিবন্ধন করে নেওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু ক’জনেই বা পরবর্তীতে নিবন্ধন করে থাকে। এই হলফনামা সম্পাদনের মাধ্যমেই বর-কনে নিজেকে সামাজিকভাবে স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে সমাজে বসবাস শুরু করে। এমন কোর্ট ম্যারেজ সাধারনত কিছু কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছেলে-মেয়ের প্রেমের সম্পর্কের ক্ষেত্রেই বেশি হয়ে থাকে।
এ থেকে বাদ যায়না স্কুল,কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীও। উঠতি বয়সের তরুন-তরুনীরা যেহেতু বেশিরভাগই লেখাপড়া জানা,বুঝা (যদিও আইন বিষয় তেমন ধারনা থাকেনা) তাই তারা মনে করেন কোর্টে গিয়ে কোর্ট ম্যারেজ করলেই মনে হয় স্বাভাবিক বিয়ের চেয়ে আরো শক্ত-পোক্ত ভাবে এ বিয়েটার কাজ সম্পন্ন হয়।
পরবর্তীতে হয়তবা তাদের অবিভাবকও এটাকে নাকচ করতে পারবে না। এমনও হয় ছেলে কিংবা মেয়ে যে কোন এক পক্ষই এ কোর্ট ম্যারেজের আসল আইনী ভিত্তি জেনে,বুঝেই আরেক পক্ষের সাথে প্রতারনার মাধ্যমে অবৈধ সুবিধা অর্জনের জন্য এমনটা করে থাকেন। আর এই প্রতারনায় সবচেয়ে বেশি শিকার হয় ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বেশি। ফলে মুসলিমদের কোর্ট ম্যারেজ খ্যাত হলফনামা সম্পাদনে অধিকার বঞ্চিত হয় মেয়েরা;থাকেনা দেনমোহর পাবার অধিকার সহ অন্যান্য।
যেহেতু প্রেমজ সম্পর্ক(Love affair) থেকেই বেশি কোর্ট ম্যারেজের হলফনামা সম্পাদন হয় সেহেতু সম্পাদনের পরে কোর্ট ম্যারেজের আসল আইনী ভিত্তি জানতে পেরে হয়তবা পারিবারিক চাপে কিংবা নিজে যে কোন পক্ষ এটাকে সহজেই অস্বীকার করে। অনেকে পারিবারিকভাবে বিষয়টি নিস্পত্তি করার চেষ্টা করে কিন্তু যেহেতু অবিভাবক ছাড়া সিন্ধান্ত ছিল ছেলে-মেয়ের তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা আর সমাধানের দিকে আলোর মুখ দেখে না। প্রথমত হয়তবা গ্রাম্য সালিশ থেকে শুরু হয় বিষয়টি সমাধানের তাই ভাগ্য ভাল হলে সঠিক সমাধানের উপায় খুঁজে পাওয়া যায়;নয়তবা শুরু হয় বিপত্তি। হয়ত তখন নেমে আসে দু’পক্ষের পারিবারিক সংঘাত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তখন শুরু হয় কনের উপর বর পক্ষের পারিবারিক সহিংসতা।
তাতেও ক্ষ্যান্ত হয়না;দিয়ে দেয় হয়তবা নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে তালাক। ঠিক যেভাবে ভুল পথে বিয়ে নামক সম্পর্ক সৃস্টি হয়েছিল সেভাবেই তা নিস্পন্ন। যে পক্ষ অস্বীকার করে তার প্রতিপক্ষ বর কিংবা কনে যেই হোক সে ভুক্তভোগী হয়ে আসল বিয়ের বৈধতা সম্পর্কে বিজ্ঞ আইনজীবীগনের দারস্ত হয়।
লেখকঃ কলাম লেখক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক,শিক্ষানবিশ আইনজীবী,জজ কোর্ট,খুলনা।
+ There are no comments
Add yours