সময়টা ছিল ২০২২ এর জুন মাস। তখন আমার অর্ধবার্ষিক এর মূল্যায়ন পরীক্ষা চলছে, এর মধ্যেই আমি জানতে পারি, আগামী সপ্তাহ থেকে জাতীয় শিশু পুরস্কার ২০২১ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। যথারীতি প্রতিবারের মতই আমি প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। স্কুলের শিক্ষকবৃন্দ আমাকে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করলেন।
যেহেতু আমার পরীক্ষা চলছিল, তাই সেভাবে প্রস্তুতিও নিতে পারিনি। এভাবে কিছুদিন কেটে গেল। মাসখানেক পর সে মুহূর্ত চলে আসলো। সকাল ১০ টা থেকে শুরু হবে প্রতিযোগিতা। আমি দেশাত্মবোধক গান গ বিভাগ এর একজন প্রতিযোগী হিসেবে অংশগ্রহণ করি। প্রথমে হয় থানা পর্যায়ে। সেখানে আমি প্রথম হলাম।
পরবর্তীতে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়েও প্রথম স্থান অধিকার করি। সম্পূর্ণ পথটি কেমন যেন আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। এর পরের ধাপ হল জাতীয় পর্যায়। আমি এতটুক অব্দি আসতে সক্ষম হবো, তা কখনো কল্পনাই করতে পারিনি। এদিকে বাসায় আমার পরিবার এবং স্কুলের সকল শিক্ষকবৃন্দ আমাকে অভিনন্দন জানাল।
তখন থেকে আমার দায়িত্ব আরো বেড়ে গেল। কিন্তু সামনেই এসএসসি পরীক্ষা এবং সিলেটে বন্যার কারণে বারবার জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতা স্থগিত হতে থাকলো। এদিকে আমিও প্রস্তুতি নিতে থাকি। আসলে সত্যি কথা বলতে কি স্কুল ও প্রাইভেট টিউটর নিয়েই সারাদিন সকাল ছয়টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়, বাসায় এসে যে আবার গানের চর্চা করব সেই শারীরিক শক্তির পাশাপাশি মানসিক শক্তিও থাকত না। কিন্তু আমি শুধু ভাবতাম আমাকে পারতেই হবে। অবশেষে ডিসেম্বর মাসের ২৪ তারিখে আমার প্রতিযোগিতার দিন নির্ধারিত হয়।
১৮ তারিখ রিপোর্টিং টাইম। তাই সকালবেলা আমি আর বাবা সকাল সাতটার ট্রেনে উঠলাম। যখন আমি বাসা থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলাম তখন আমার মন কেমন যেন করছিল। মনে হচ্ছিল আমি শুধুশুধুই ঢাকা যাচ্ছি। কিন্তু বাসার প্রত্যেকে আমাকে মনোবল জোগালো। অবশেষে একটার দিকে আমরা কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌছালাম। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়েই চলে গেলাম দোয়েল চত্বরে যেখানে বাংলাদেশ শিশু একাডেমী অবস্থিত। আসলেই কিছু বিশ্বাস হচ্ছিল না যে চট্টগ্রাম থেকে এসেছি জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করার জন্য। রিপোর্টিং করার পরে আমি আর বাবা চলে গেলাম ধানমন্ডিতে আমার মামার বাসায়। সেখানেই বেশকিছু দিন থাকলাম।
২৪ তারিখ। অবশেষে আমার জীবনের সেই স্বপ্নময় মুহূর্ত চলে এসেছে। সকালবেলা তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে আগে আমি গোসল সেরে গানের রেওয়াজে বসে গেলাম। তারপরে খাবার খেয়ে তৈরি হয়ে রওনা হলাম গন্তব্য স্থলের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম সকাল দশটা থেকে প্রথমে ২০২০ সালের এবং পরে ২০২১ সালের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। তাই আমি আর বাবা প্রায় বিকেল ৪ টা ৩০ পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম।
সেখানে অনেক প্রতিযোগীর সাথে আমার পরিচয় হলো। আমার মতোই বাংলাদেশের আট বিভাগ থেকে আটজন এসেছে। অবশেষে প্রায় ৫ টার দিকে দেশাত্মবোধক গানের প্রতিযোগিতা শুরু হল। সকালে থেকে সেখানে থেকে একটু শারীরিক ভাবে দুর্বল বোধ করছিলাম। কিন্তু আমি তখন শুধু আমার মনের কথা শুনেছি।
সেখানে বিচারক হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য বিশিষ্ট সুরকার শেখ সাদী খান, বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী কল্যাণী ঘোষ এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক মহোদয়ের উপস্থিতিতে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। আমার নাম ডাকা হল। জোরে একটা প্রশ্বাস নিয়ে দুঃখ বেদনা ভয় কে বের করে দিয়ে স্রষ্টাকে স্মরণ করে হাসিমুখে সেই মুহূর্তে আমার ভালোটা দিয়ে গান পরিবেশন করলাম।
গান পরিবেশন করার সময়ে কেন জানিনা এক ঝলক আমার ওস্তাদ সুরবন্ধু অশোক চৌধুরী এর মুখখানি মনে ভেসে উঠলো। আমার শুধু একটাই চাওয়া ছিল, প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় হই বা না হই না কেন, আমি যেন সব বিচারককে গানের মাধ্যমে তাদের মনকে সন্তুষ্ট ও আনন্দে ভরিয়ে দিতে পারি। সব প্রতিযোগীদের গান গাওয়ার পর পরই ফলাফল ঘোষণার পালা। তখন আমি বাবাকে বলছিলাম, আমি হয়তো কিছুই হবো না।
চলো চলে যাই। কিন্তু বাবা আমাকে প্রতিবারের মতই মনে শক্তি জোগালেন এবং উদ্বিগ্ন হতে নিষেধ করলেন। যে কক্ষে ফলাফল ঘোষণা হচ্ছিল, সেখান থেকে আমি আগেই বের হয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমি কিছুই হবো না। কিন্তু যখন আমি ‘শ্রাবন্তী চৌধুরী’ শব্দটি ঘোষণায় শুনতে পেলাম, তখন হৃদয় আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। আমি জাতীয় শিশু পুরস্কার ২০২১ প্রতিযোগিতায় সারা বাংলাদেশে দেশাত্মবোধক গানে তৃতীয় স্থান অর্জন করি। সেই মুহূর্তটা আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
শ্রাবন্তী চৌধুরী
নবম শ্রেণী, চট্রগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ, চট্টগ্রাম সেনানিবাস
+ There are no comments
Add yours